বিবাদ যেন কিছুতেই থামছে না। কখনও জমি নিয়ে গন্ডগোল, কখনও পাড়ায় পাড়ায় সংঘর্ষে বোমা-গুলি চলার অভিযোগ, কখনও আবার খোদ শাসকদলের পুরপ্রতিনিধিকেই খুনের চেষ্টার ঘটনা নিয়ে চাপানউতোর! এ বার সরাসরি অন্তত ৬০টি পরিবারকে জল পরিষেবা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার অভিযোগ উঠল। পরিস্থিতি দেখে রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, কসবায় তৃণমূলের দুই পুরপ্রতিনিধি সুশান্ত ঘোষ এবং লিপিকা মান্নার মধ্যে শান্তির সহাবস্থান যেন হচ্ছেই না!
এ বারও ভুক্তভোগীরা সরাসরি দাবি করেছেন, তাঁরা সুশান্ত-ঘনিষ্ঠ। লিপিকার দফতরে নিয়মিত হাজিরা দেন না বলেই তাঁদের জলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি লিপিকা। যদিও অভিযোগ উড়িয়ে মঙ্গলবার লিপিকার মন্তব্য, ‘‘তেমন কোনও বিবাদের ব্যাপারই নেই। আরও বেশি সংখ্যায় জলের সংযোগ পাইয়ে দিতে কয়েকটি সংযোগ বন্ধ করা হয়েছিল মাত্র। নতুন করে আবার সব করে দেওয়া হচ্ছে।’’ সুশান্তও বিবাদের তত্ত্ব উড়িয়ে শুধু বলেছেন, ‘‘সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তাই তাঁরা আমায় তাঁদের সমস্যার কথা বলেন। জল না পাওয়ার কথা আমায় তাঁরা লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন, আমি মেয়রকে জানিয়েছি।’’ মেয়র ফিরহাদ হাকিম অবশ্য এ দিন বলেছেন, ‘‘জলের লাইন কাটা অন্যায় হয়েছে। এ দিনই পুর কমিশনারের তরফে নির্দেশিকা জারি হয়েছে, পুর কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও জলের লাইন কাটা যাবে না।’’ এর পরে মেয়রের মন্তব্য, ‘‘সকলের যে যাঁর নিজের এলাকায় কাজ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, মানুষের সেবার জন্য জনপ্রতিনিধি হয়ে এসেছেন।
বদলা বা প্রতিহিংসার জন্য রাজনীতি করা নয়।’’
কসবার স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেরই দাবি, সুশান্ত-লিপিকা বিবাদ সামনে এলেই প্রশাসনিক শীর্ষ স্তর থেকে এমন ‘দু’পক্ষকেই সতর্ক করা হচ্ছে’ ধরনের মন্তব্য শোনা যায়। কিন্তু তাতে কাজের কাজ হয় কি, প্রশ্ন তাঁদের। ২০১০ সালে কসবায় ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডে পুরপ্রতিনিধি হিসাবে প্রথম বার জেতেন সুশান্ত। ২০১৫ সালে সেখান থেকেই দ্বিতীয় বার জিতে পুরপ্রতিনিধি হন। ২০১৫ সালে ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রতীকে পুরপ্রতিনিধি হয়েছিলেন এক প্রাক্তন ফুটবলার। সেই সময়ে তাঁকে সুশান্ত সাহায্যও করতেন বলে স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের দাবি। কিন্তু ২০২১ সালের কলকাতার পুর নির্বাচনে সংরক্ষণের কারণে ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করা হয় লিপিকাকে। সুশান্তকে সরতে হয় ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে। দু’জনেই জেতেন। এ ক্ষেত্রে লিপিকার অনুগামীদের অভিযোগ, সুশান্তের অনুগামীরা এখনও ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতিনিধির কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। তা থেকেই সব গোলমালের সূত্রপাত। স্থানীয় এক বাসিন্দা যদিও বললেন, ‘‘বিবাদের মূলে রয়েছে এই এলাকার সরকারি জমির হাতবদলের ক্ষমতা কার কাছে থাকবে, সেই বিষয়টি। আন্তর্জাতিক জলাভূমি সংরক্ষণ প্রকল্প রামসর সাইটের তালিকাভুক্ত কসবার এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। এখানে যে কোনও ধরনের নির্মাণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শুধু নির্মাণই নয়, ক্ষমতার হাত মাথায় থাকলে এখানে সরকারি হোর্ডিং সরিয়ে ফেলে চলে দেদার নির্মাণকাজ। নির্মাণ ঘিরেই টাকা ওড়ে এখানে।’’
বিতর্ক উস্কে সুশান্তই এক সময়ে ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি লিপিকার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘আগে কাউন্সিলর হয়েছে, তার পরে দল করেছে। আগে স্কোয়ার ফুট চিনেছে, তার পরে দল চিনেছে।’’ লিপিকা যদিও সেই সময়ে পাল্টা মন্তব্য করে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্ব সামনে আনেননি। তবে এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়, টাকা তোলা ঘিরে অন্য সাম্রাজ্যের গল্প। যে সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হাতে রাখতে গন্ডগোল শুরু হতে পারে যে কোনও সময়ে!
লিপিকা যদিও এই জলের গন্ডগোল মেটাতে এ দিনই ভুক্তভোগী পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলেছেন। এর পরে তিনি বলেন, ‘‘চারটি জলের লাইনের বদলে ১২টি জলের স্ট্যান্ড পয়েন্টে দু’দিকে দু’টি মুখ করে মোট ২৪টি কল বসানো হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার জন্য ১৬০ মিটার জলের নতুন পাইপলাইন বসানো হয়েছে। চারটি জলের লাইন কেটে দেওয়া হলেও তার পাশেই নতুন জলের কল বসানো হয়েছে। তবে তার পরেও সমস্যা হলে বলছি, যে চারটি লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন কল থেকে জল আনতে কোনও সমস্যা হবে না।’’
আপাতত সমস্যা মিটলেও দুই পুরপ্রতিনিধির বিবাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কিছু হবে কী? প্রশ্ন থেকেই যায়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)