Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Sarsuna

সরশুনার হোমে শিশু-কিশোরীদের যৌন হেনস্থা! অভিযুক্তকে ছেড়ে দিয়ে কাঠগড়ায় পুলিশও

অভিভাবকদের দাবি, দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণি মিলিয়ে ৭-৮ জন শিশু-কিশোরীকে যৌন হেনস্থা করেছেন অভিযুক্ত হরিপদ দাস।

সরশুনার এই হোমেই যৌন হেনস্থার অভিযোগ। —নিজস্ব চিত্র

সরশুনার এই হোমেই যৌন হেনস্থার অভিযোগ। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৯ ১৮:৫৭
Share: Save:

হোমে শিশু-কিশোরীদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠল ফের। সেই অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ তা নেয়নি। এমনকি, অভিযুক্তকে ধরে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠল তাদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য অভিভাবকদের চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সরশুনা থানার পুলিশ ও ওই হোম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। হোম ও পুলিশের ভূমিকায় ভূমিকায় তোলপাড় গোটা সরশুনা এলাকা।

যদিও হোম কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হোম পরিদর্শন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী।

সরশুনার ১ নম্বর রাখাল মুখার্জি রোডে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামে ওই হোমে ৫ থেকে ১৮ বছরের শিশু-কিশোরীদের রাখা হয়। মূলত অভাবী বাবা-মায়েরা, যাঁরা কর্মব্যস্ততার জন্য সন্তানদের লালনপালন করতে পারেন না, এমন পরিবারের শিশু-কিশোরীরাই থাকে ওই হোমে। সব মিলিয়ে হোমে রয়েছে ১০৫ জন আবাসিক। প্রতি বছরের ১৭ নভেম্বর ওই হোমে বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় অভিভাবকদেরও। আসেন হোমের পরিচালন বোর্ডের সদস্যরা। থাকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন।

এ বারও সেই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ঘটনার সূত্রপাত সেই ১৭ নভেম্বর। অভিভাবকরা হোমের অনুষ্ঠানে এলে কয়েক জন আবাসিক শিশু-কিশোরী তাদের মা-বাবার কাছে অভিযোগ করে, তাঁতের শিক্ষক যৌন হেনস্থা করেছেন। এ নিয়ে অভিভাবকরা প্রতিবাদ জানান। হোমে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার মানুষ জড়ো হন হোমে। পাশাপাশি হোমের কাছেই একটি ক্লাব থেকে কয়েক জন যুবক গিয়ে অভিযুক্ত তাঁতের শিক্ষক হরিদাস বিশ্বাসকে মারধর করে বলে অভিযোগ। ১০০ নম্বরে ফোন করা হলে সরশুনা থানার পুলিশ এসে হরিদাসকে নিয়ে যায়। কিন্তু ওই রাতেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: সরছে পায়ের তলার মাটি, কপালে ভাঁজ মোদী-শাহের

বুধবার এক শিশুর মা বলেন, ‘‘ওই দিন অনুষ্ঠানে আসার পর আমার মেয়ে খুব কাঁদছিল। আমি জিজ্ঞেস করায় বলে, আমরা দোলনা চড়ছিলাম। তাঁতের কাকু আমাদের মেরেছে।’’ নিউ আলিপুরের বাসিন্দা পেশায় রাজমিস্ত্রির সাহায্যকারী অন্য এক অভিভাবক বলেন, ‘‘মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আমরা সন্ধ্যাবেলায় এলে মেয়ে কাঁদছিল। মেয়ে ওর মাকে বলে, কোলে নেওয়ার নাম করে যৌনাঙ্গে হাত দিয়েছে।’’ অন্য অভিভাবকদের দাবি, দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণি মিলিয়ে ৭-৮ জন শিশু-কিশোরীকে যৌন হেনস্থা করেছেন অভিযুক্ত হরিদাসদাস।

অভিভাবকদের দাবি, ওই রাতের ঘটনার পরে তাঁরা থানায় গেলে অভিযোগ নেয়নি। উল্টে তাঁদের বলা হয়, অভিযোগ জানালে অভিযোগকারী শিশুদের সরকারি হোমে নিয়ে যাওয়া হবে। এ ছাড়া মামলা দায়ের হলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে এবং প্রচুর খরচও হবে। ফলে তাঁরা অভিযোগ করেননি। পুলিশও সেই সুযোগে অভিযুক্ত শান্তিপুরের বাসিন্দা বছর তেত্রিশের হরিদাস বিশ্বাসকে ছেড়ে দেয়। সরশুনা থানার এক আধিকারিকের বক্তব্য, খবর পেয়ে তাঁরা হোমে গিয়েছিলেন। অভিযুক্তকে থানায় নিয়েও আসেন। কিন্তু তাঁরা জানতে পারেন, কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া নিয়ে ওই তাঁত প্রশিক্ষকের সঙ্গে বিবাদ হয় হোমের আবাসিকদের। তবে অভিভাবকদের পুলিশ ভয় দেখিয়েছে, সে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই ঘটনার পর গত ২১ নভেম্বর হোমে যান স্থানীয় ১২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শিপ্রা ঘটক। তিনি হোম কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে কাউন্সিলরও বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার কথা বলেন বলে অভিভাবকদের দাবি। ওই সালিশি সভার কথা স্বীকার করেছেন হোমের মেট্রন ডলি মণ্ডলও।

আরও পডু়ন: শিয়ালদহ লাইনে ফের চলন্ত ট্রেনে পাথর, রক্ত ঝরল মহিলা যাত্রীর

গোটা এই ঘটনাক্রম জানার পরে আগেও এক বার হোম কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী। বুধবার ফের তিনি হোমে গিয়ে পুলিশ, কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সঙ্গে ফের কথা বলেন। পরে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বলেন, ‘‘এটা কটেজ হোম। কোনও পুরুষ প্রশিক্ষক এই ধরনের হোমে রাখা জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের বিরোধী। কর্তৃপক্ষ কেন রেখেছেন, আমরা জানি না। প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছে, অভিভাবকদের ভয় দেখিয়ে মিটিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাঁদের সন্তানদের হোম থেকে নিয়ে যেতেও বাধ্য করা হয়েছে। পুলিশও ভয় দেখিয়েছে। যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করেছে। আমি সামগ্রিক রিপোর্ট, সমাজকল্যাণ দফতরকে দিচ্ছি। আমরা শীঘ্রই শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দায়ের করব।’’

হোমের মেট্রন ডলি মণ্ডল অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, ‘‘আসলে এ রকম নয় বিষয়টা। বাচ্চাদের বকাবকি, হয়তো বা একটু মারধরও করা হয়েছিল। তবে যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা ঘটেনি।’’ পুরুষ প্রশিক্ষকের প্রশ্নে হোমের পরিচালন সমিতির সচিব পূর্ণা চৌধুরীর দাবি, ‘‘তাঁতের কাজ শেখানোর জন্য মহিলা প্রশিক্ষক পাওয়া যায় না। সে কারণেই পুরুষ প্রশিক্ষক রাখতে হয়েছে। ছাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন। তাঁরা স্বেচ্ছায় মুচলেকা দিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।’’ শুধু তাই নয়, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই হরিদাসদাস যৌন হেনস্থা করেছেন বলেও মানতে রাজি নন পূর্ণাদেবী।

কিন্তু অভিভাবকরা বলছেন, ১৭ তারিখ ওই ঘটনার দিন যাঁরা বেশি প্রতিবাদ করেছিলেন, একটি মুলচেকা লিখিয়ে নিয়ে তাঁদের দিয়ে বাচ্চাদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। হোম কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট বলে দেন, তাঁদের সন্তানদের রাখা সম্ভব নয়। হোমে রান্নার কাজ করা এক মহিলার মেয়েও ওই হোমে থাকত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি রাতে হোমেই থাকতাম। ওই দিনের ঘটনার পরেই আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে বলা হয়। আমাকেও কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন হোম কর্তৃপক্ষ।’’

যৌন হেনস্থার পাশাপাশি হোমের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। হোমের উল্টো দিকের বাড়ির বাসিন্দা অনুরূপা রায় বলেন, ‘‘বাচ্চার বাবা-মায়েরা অভিযোগ করছিলেন সেটা আমরা দেখেছি। কয়েক জন বাচ্চাকে বাবা-মায়েরা নিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছেন, সেটাও চোখে পড়েছে। এর আগে এ রকম কোনও ঘটনা ঘটেছে বলে শুনিনি। তবে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখার মতো নানা অব্যবস্থা নিয়ে অভিভাবকরা মাঝেমধ্যেই প্রতিবাদ করেন, সে ধরনের ঘটনা আগেও কানে এসেছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Sarsuna Children Home Molestation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy