মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে রানি পান্ডে। নিজস্ব চিত্র।
মাথা থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। কোনও রকমে মাথায় হাতচাপা দিয়ে সেই অবস্থাতেই থানায় দৌড়েছিলেন বছর বিয়াল্লিশের রানি পান্ডে। মহিলাকে ও রকম রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে, রিজেন্ট পার্ক থানার পুলিশকর্মীরাই তাঁকে এমআর বাঙুর হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসা করিয়ে থানায় অভিযোগ জানাতেও বলেন তাঁরা।
সেই মতো রানি বাঙুর হাসপাতালে গিয়ে নিজের চিকিৎসা করান। তার পর ফের থানায় আসেন। পুলিশের কাছে করা অভিযোগে রানি জানান, দীর্ঘ দিন ধরেই দেওর দিবাকর পান্ডের সঙ্গে পারিবারিক একটি বিষয়ে সমস্যা রয়েছে তাঁদের। রবিবার সন্ধ্যায় দিবাকরের সঙ্গে সেই বিষয় নিয়েই তাঁর কথা কাটাকাটি শুরু হয়। সেই সময় রানির গলা টিপে ধরেন দিবাকর। তার পর একটি ভারী কাঠের ডান্ডা দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেন তিনি। তাতে মাথা ফেটে যায় রানির। তাঁর দাবি, সে দিন পুলিশের কাছে তিনি বার বার জানিয়েছিলেন, দিবাকর তাঁকে খুনের চেষ্টা করেছিলেন।
ঘটনাটি যখন ঘটে রানি তখন একাই ছিলেন বাড়িতে। তাঁর মেয়ে রিঙ্কির কথায়, ‘‘কথা কাটাকাটির মাঝেই কাকা হঠাৎ মাকে ধাক্কা মারে। ঘরে ঢুকে মারতে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে মা চিৎকার করলে তার গলা টিপে ধরে কাকা। তার পর একটা ভারী কাঠের ডান্ডা দিয়ে মায়ের মাথায় মারে।” তিনি জানান, ওই আঘাতে তাঁর মায়ের কপাল থেকে মাথার মাঝখান পর্যন্ত গভীর ক্ষত তৈরি হয়। এম আর বাঙুল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তিনটি সেলাই পড়ে। যদিও মাথার মাঝখানের ক্ষতে সেলাই করা যাবে না বলে জানান চিকিৎসকরা। রানির ছেলে প্রভাকর জানান, থানায় গিয়ে গোটা ঘটনা জানান তাঁরা। পুলিশকে মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখানো হয়। ওই রাতেই পুলিশ গ্রেফতার করে দিবাকরকে।
রানি পান্ডের মেডিক্যাল রিপোর্টেও গুরুতর আঘাত এবং শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টার কথা বলা হয়েছে। নিজস্ব চিত্র।
কিন্তু পর দিন অর্থাৎ সোমবার দিবাকরকে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেতে দেখে অবাক হয়ে যায় প্রভাকর। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, পুলিশ খুনের চেষ্টার বদলে অপেক্ষাকৃত কম ধারায় মামলা করেছে দিবাকরের বিরুদ্ধে। ভোঁতা কোনও কিছু দিয়ে আঘাত করলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৪ ধারায় মামলা করা হয়। এ ক্ষেত্রেও দিবাকরের বিরুদ্ধে সেই লঘু ধারাতেই মামলা করা হয়েছে। সাধারণত ছোটখাটো মারামারির ক্ষেত্রে এই ধারা প্রয়োগ করে পুলিশ। এবং তা জামিনযোগ্য অপরাধ। জামিনের কথা জানতে পেরে এর পর প্রভাকর স্থানীয় ৯৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায়কে গোটা ঘটনার কথা জানান।
আরও পড়ুন: তিন বার পোশাক বদল, ধোঁয়াশা পঞ্চসায়র গণধর্ষণ-তদন্তে
এর পরেই ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। মিতালি পুরো বিষয়টি জানান রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার মিতালির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি তো রানির ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে যাই! ওর মাথায় তো গুরুতর আঘাত লেগেছে। এত বড় ঘটনা। তার পর পুলিশ এ রকম কেন করল বুঝতে পারলাম না।” মন্ত্রীকে জানানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি রানির আঘাতের ছবি নিয়ে সোজা চলে যাই অরূপদার কাছে। মন্ত্রীকে দেখাই। তিনিই তার পর রিজেন্ট পার্ক থানায় যোগাযোগ করেন। শুধু তাই নয়, রানির শারীরিক অবস্থাও খারাপ ছিল। কিন্তু হাসপাতাল ভর্তি নিচ্ছিল না। অরূপদার সাহায্য নিয়েই সোমবার ওঁকে হাসপাতালে ভর্তি করাই।”
রানি পান্ডের বাড়িতে এ ভাবেই ছিল রক্তের দাগ। নিজস্ব চিত্র।
মন্ত্রীর ফোনেই যে পুলিশের টনক নড়ে, তা প্রমাণ হয় সোমবার রাতেই। এমআর বাঙুর হাসপাতালে ছুটে যায় রিজেন্ট পার্ক থানার পুলিশ। রানির বয়ান রেকর্ড করা হয়। মামলায় নতুন ধারা যোগ করতে চেয়ে মঙ্গলবার আদালতে আবেদনও জানায় তারা। দিবাকরকে ধরতেও তাঁর বাড়িতে যায় পুলিশ। কিন্তু তত ক্ষণে তিনি চম্পট দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: সুড়ঙ্গে আটকে পড়া যন্ত্র সরাতে অনুমতি কোর্টের
এই বিযয়ে ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) সুদীপ সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘ওই মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ ধারায় খুনের চেষ্টার অভিযোগ যুক্ত করা হয়েছে।” মহিলা বার বার খুনের চেষ্টার কথা বলা সত্ত্বেও পুলিশ কেন এফআইআরে সে কথা লিখল না, কেনই বা ৩২৪ ধারা দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
তবে, গোটা ঘটনায় পুলিশের অপদার্থতার বিষয়টিই সামনে এসেছে বলে মনে করছেন আলিপুর আদালতের আইনজীবী অনির্বাণ গুহ ঠাকুরতা। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের ঘটনা ঘটলে খুনের চেষ্টা বা অনিচ্ছাকৃত খুনের চেষ্টার মতো ধারায় মামলা হওয়া উচিত। একটা মামলায় শুরুর সময় থেকেই সঠিক ধারাগুলি যুক্ত করার কথা তো শীর্ষ আদালত বার বার বলছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই ক্ষেত্রে পুলিশ যদি শুরুতেই ঘটনাস্থলে যেত, যথাযথ ভাবে মেডিক্যাল রিপোর্ট খতিয়ে দেখত, তা হলে হয়তো এমনটা ঘটত না। আসলে অভিযোগকারিণীর অভিযোগকে গুরুত্বই দেয়নি পুলিশ।’’
আরও পড়ুন: অসমের মাদক চক্র পাকড়াও কলকাতায়, উদ্ধার ১৩৩ কিলো গাঁজা
কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তাও যেমন এটাকে বাহিনীর গাফিলতি হিসেবেই দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ কমিশনার বার বার বলছেন, থানার আধিকারিকদের পারফর্ম করতে। অথচ রিজেন্ট পার্কের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ থানায় এমন দায়সারা মনোভাব কেন দেখানো হল, বুঝতে পারছি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy