বাধা: ট্যাক্সির পিছনের কাচে স্টিকার। সামনের গাড়িগুলিতেও লাগানো তেমনই স্টিকার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
গাড়ির পিছনের কাচ জুড়ে ঠাকুর-দেবতার ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য কিংবা নেতা-নেত্রীর ছবির স্টিকার। এ সবের জেরে চালকের বোঝারই উপায় নেই যে, পিছনে ক’টি গাড়ি কত গতিতে ধেয়ে আসছে। উইন্ডস্ক্রিনেও স্টিকার সাঁটা। এ ভাবেই গাড়ি ‘সাজিয়ে’ শহরের রাস্তায় চলছে বেপরোয়া যাতায়াত।
অভিযোগ, এই কারণে অনেক গাড়িতেই চালকের আসনে বসে বাইরে স্পষ্ট দেখা যায় না। ‘ফিল্ম’ বসিয়ে মুড়ে ফেলা হচ্ছে গাড়ির জানলার কাচও। ঘোলাটে কাচে দৃশ্যমানতা এতই কম যে, অন্ধকার নামলে বোঝার উপায় নেই পিছন থেকে দ্রুত গতিতে আসা গাড়ি কোন দিক থেকে আসছে। গাড়ির লুকিং গ্লাস বা সাইড ভিউ মিররও এই কাচের জন্য কার্যত অন্ধ।
এই ‘অন্ধ পথে’ গাড়ি চালিয়ে প্রায়ই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গত এক বছরে এই ধরনের গাড়ির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যার বৃদ্ধি পুলিশের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, বছরের অনেকটা সময় লকডাউন চললেও এ রাজ্যে এমন গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে প্রায় ৮২ হাজার। যে সংখ্যা ২০১৯ সালে ৬৫ হাজার এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ছিল। গত এক বছরে স্রেফ কলকাতাতেই ৯১টি পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী ছিল গাড়ির কাচের দৃশ্যমানতার অভাব। প্রতিটি ঘটনাতেই গাড়ির কাচ ঘোলাটে ছিল, নয়তো চালকের দৃষ্টিপথ আটকে লাগানো হয়েছিল ছবি বা স্টিকার।
পূর্ব যাদবপুর ট্র্যাফিক গার্ডের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘গত ডিসেম্বরের শুরুতেই দ্রুত গতির একটি গাড়ি সরাসরি মেট্রোর স্তম্ভে ধাক্কা মেরে উল্টে যায়। কোনও মতে চালক বেঁচে যান। গাড়িটি সোজা করলে দেখা যায়, পিছনের কাচ জুড়ে স্টিকার লাগানো। প্রতিটি জানলার কাচেও ঘোলাটে কোটিং করা। হাসপাতালে শুয়ে চালক জানিয়েছিলেন, রুবি মোড়ে কসবা কানেক্টরের দিক থেকে যে একটি গাড়ি দ্রুত গতিতে আসছে, তা তিনি দেখতে পাননি। ওই গাড়ির হেডলাইট বন্ধ ছিল। যখন বুঝেছিলেন, তত ক্ষণে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ডান দিকে সরতে গিয়ে সরাসরি মেট্রোর স্তম্ভে ধাক্কা মারেন।
হেস্টিংসের কাছে আবার একটি গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষে রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছনে থাকা আর একটি গাড়ি ওই গাড়ির পিছনে সজোরে ধাক্কা মেরে উল্টে যায়। তারও পিছনে থাকা একটি মালবাহী লরি সেই দ্বিতীয় গাড়িটিকে ধাক্কা মারে। ওই গাড়ির তিন সওয়ারির কেউই বাঁচেননি। প্রথম গাড়ির চালক পুলিশি জেরায় জানান, গাড়ির পিছনের ‘পার্সল ট্রে’-তে মেয়ের খেলনা রাখা ছিল। আর গ্রাফিক্স করানো থাকায় পিছনে গাড়ি ছিল কি না, দেখতে পাননি!
এমন গাড়ি শহরে চলে কী করে?
মোটরযান আইনের ১৯২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কোনও গাড়িরই সামনের এবং পিছনের কাচের কোনও অংশ ঢেকে চলার কথা নয়। ওই দুই কাচ দিয়ে আলো চলাচলের মাত্রা ৭০ শতাংশের কম করা যাবে না। গাড়ির জানলার কাচও অস্বচ্ছ করা বেআইনি। আইন অনুযায়ী, জানলার কাচ দিয়ে আলো চলাচলের মাত্রা ৫০ শতাংশ রাখতেই হবে। আইন ভাঙলে পুলিশ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও মামলা করতে পারে। পরে একই অপরাধে ধরা পড়লে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
কিন্তু অভিযোগ, আইন থাকে খাতায়-কলমেই। বিনা বাধায় এই সব গাড়ি একের পর এক ট্র্যাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে যায়। এমনকি গাড়ির স্বাস্থ্য-পরীক্ষাও বিনা বাধায় হয় রিজিয়োনাল ট্রান্সপোর্ট অফিসে (আরটিও)।
পরিবহণ দফতরের কেউই অবশ্য এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। বেলতলার রিজিয়োনাল ট্রান্সপোর্ট অফিসের (আরটিও) এক আধিকারিক বলেন, ‘‘গাড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর আগে অনেকেই ও সব খুলিয়ে নিয়ে আসেন। তার পরে আবার লাগান। তাই পুলিশেরই এটা দেখার কথা।’’ কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্র্যাফিক) অরিজিৎ সিংহ যদিও বললেন, ‘‘এমন গাড়ি রাস্তায় দেখা গেলেই নির্দিষ্ট ধারায় মামলা করে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তা ছাড়া, পথ নিরাপত্তা সপ্তাহে তো বটেই, সারা বছরই এই ভাবে গাড়ি না চালানো নিয়ে সচেতনতার প্রচার চালানো হয়।’’
কিন্তু সেই প্রচারে কাজ হয় কি? পথের অভিজ্ঞতা যদিও অন্য কথাই বলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy