বেহাত: ফুটপাতে গাড়ি রেখে সারাইয়ের কাজ। উধাও চলার জায়গা। বুধবার, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের কাছে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
ফুটপাত বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সার দিয়ে রাখা গাড়ির সামনের চাকা দু’টি শুধু রয়েছে রাস্তার উপরে। বাকিটা ফুটপাতে। এই অবস্থায় কোনওটিতে বাহারি আলো লাগানোর কাজ চলছে, কোনওটিতে ‘ফিল্ম’ লাগিয়ে কালো করা হচ্ছে কাচ। কোনওটির আবার ইঞ্জিনের নীচে ঢুকে কাজ করে চলেছেন কেউ!
ওয়েলিংটনের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির নীচে ঢুকে কাজ করার সময়ে কোমর থেকে শরীরের নীচের অংশটুকু বেরিয়ে ছিল তালতলার বাসিন্দা সদানন্দ সাহার। দ্রুত গতিতে আসা একটি গাড়ি তাঁর দু’পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও চিকিৎসকেরা ওই যুবকের একটি পা-ই বাঁচাতে পেরেছেন। অন্যটি কাটা গিয়েছে। পুলিশ তদন্তে গিয়ে দেখে, একমুখী রাস্তায় গাড়ির জট কাটিয়ে তড়িঘড়ি বেরোতে গিয়েই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন চালক।
কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, শহর জুড়ে পথ আটকে গাড়ির কাজের ব্যবসা চলছে যেখানে, সেখানে প্রায়ই এমন সব ঘটনা ঘটে। পুলিশ সূত্রেরই দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার শিকার হন ফুটপাত ছেড়ে পথে নেমে আসা মানুষজন। গত পাঁচ বছরে ৬০ হাজারেরও বেশি এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রের খবর। কিন্তু তার পরেও হাই কোর্টের নির্দেশে শুধুমাত্র মল্লিকবাজার নিয়ে তৎপরতা শুরু হলেও বাকি জায়গাগুলি থেকে যায় আলোচনার বাইরেই। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুলিশের চোখের সামনেই সেখানে রাত-দিন বিধি ভেঙে চলতে থাকে গাড়ির ব্যবসা!
বুধবার দেখা গেল, মল্লিকবাজার থেকে কিছুটা দূরেই ওয়েলিংটনের ‘গাড়ি মহল্লা’য় তেমন কোনও উদ্যোগ নেই। সচেতনতারও কোনও বালাই নেই সেখানকার ব্যবসায়ীদের। রীতিমতো রাস্তা দখল করে চলছে গাড়ির কাজ। কাছেই কর্তব্যরত এক ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, ‘‘এখানে বহু দিন ধরেই এ সব চলছে। উপরমহলের নির্দেশ না এলে আমাদেরও কিছু করার নেই।’’ একই পরিস্থিতি কাঁকুড়গাছি মোড়ের কাছেও। সেখানে এক দিকে এমন একাধিক দোকান রয়েছে। ঘিঞ্জি এলাকা, তবু গাড়ি রাখা থাকে রাস্তাতেই। ব্যস্ত সময়ে তো বটেই, ওই সমস্ত গাড়ির জন্য অন্যান্য সময়েও প্রবল যানজট তৈরি হয় রাস্তার মোড়ে। স্থানীয় এক দোকানি আবার বললেন, ‘‘সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করছি। পুলিশ তো একটু ছাড় দেবেই। তা ছাড়া, পুলিশের সুযোগ-সুবিধাও তো আমরা দেখেই দিই!’’ কী রকম সুবিধা? গরফার শহিদনগরে বিদ্যুতের তার ফেলে ফুটপাত এবং রাস্তার কিছুটা জুড়ে দাঁড় করানো গাড়ির কাজ করার ফাঁকে এমনই এক দোকানের মালিক বললেন, ‘‘সব হিসাব সব জায়গায় বলা যায় না। এটুকু বলতে পারি, এমন ভাবে কাজ করা বেআইনি নয়।’’
আইনজীবীদের বড় অংশই অবশ্য জানাচ্ছেন, রাস্তা আটকে যে কোনও ব্যবসাই বেআইনি। আইনজীবী সৌরভ দত্ত বললেন, ‘‘২০১৪ সালের পথ বিক্রেতা (জীবিকা সুরক্ষা ও পথ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ) আইনকে হাতিয়ার করে অনেকে এই ধরনের ব্যবসার পক্ষে কথা বলেন। হকারি এবং এই ধরনের ব্যবসা কিন্তু এক নয়। এ ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভা থেকে রীতিমতো লাইসেন্স নিতে হয়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘১৯৮০ সালের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন অনুযায়ী, ট্রেড লাইসেন্স পেতে ‘ট্রেডিং জ়োন’ স্পষ্ট করে দেখাতে হয়। এর জন্য যে ফর্ম পূরণ করতে হয়, তাতে দোকানের নাম-ঠিকানার পাশাপাশি জানাতে হয়, দোকানটি কতটা জায়গার উপরে রয়েছে। সেটি ভাড়ায় নেওয়া, না কি নিজস্ব মালিকানাধীন, তা-ও জানাতে হয়। দোকানঘর কেনা যায় বা ভাড়ায় নেওয়া যায়। কিন্তু রাস্তা কেনা বা ভাড়া নেওয়া যায় কি?’’
কিছু দিন আগেই রাস্তা আটকে গাড়ির কাজ করানোর প্রতিবাদ করায় আক্রান্ত হয়েছিলেন আইনজীবী গৌতম ঘোষ। তিনি বললেন, ‘‘গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির লাইসেন্স নিয়ে রাস্তা আটকে গ্যারাজ ওয়ার্ক করা হচ্ছে। আইপিসি, সিআরপিসি তো রয়েছেই, পুলিশ আইনকেও হাতিয়ার করে কড়া পদক্ষেপ করা যায়। কিন্তু সমস্যা দেখেও পুলিশ বহু সময়েই কিছু করে না। নাগরিকদের অভিযোগ পেয়েও বহু ক্ষেত্রেই নীরব দর্শক হয়ে থাকে।’’ ডিসি (ট্র্যাফিক) সূর্যপ্রতাপ যাদবকে এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও উত্তর দিতে চাননি। যুগ্ম নগরপাল পদমর্যাদার এক অফিসার শুধু বলেন, ‘‘কোর্টের নির্দেশের পরে থানাগুলিকে এমনিই সতর্ক হতে বলা হয়েছে। দ্রুত ধরপাকড় শুরু হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy