অভিনব: সেই মূর্তির সঙ্গে শ্বেতা, তার মা আশা এবং আয়ুষ। বুধবার, বেলগাছিয়ার মনোহর অ্যাকাডেমি স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র।
স্কুলে পূজিত হচ্ছে সরস্বতীর মূর্তি। তবে তা কেশহীন। সেই কেশহীন সরস্বতী মূর্তির আবরণ উন্মোচন করল স্কুলেরই দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী শ্বেতা মিশ্র। তার মাথার চুলও খুব ছোট ছোট। শ্বেতার সঙ্গে কোথাও কি মিল আছে এই কেশহীন সরস্বতীর?
মিল খুঁজে পেয়েছেন বেলগাছিয়া মনোহর অ্যাকাডেমির শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তাই সরস্বতী পুজোর দিন তাঁদের স্কুলের এই ছাত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের স্কুলের সরস্বতী হল শ্বেতাই। ব্রেন টিউবারকিউলোসিসের মতো কঠিন রোগের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এ বার শ্বেতা উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। রোগের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে ওষুধের প্রভাবে তার চুল ঝরে গিয়েছিল। তবে হার মানেনি শ্বেতা। চালিয়ে গিয়েছে পড়াশোনা। চুল ঝরে পড়ার জন্য তার যাতে সঙ্কোচ না হয়, সে যেন লড়াই চালিয়ে যেতে পারে, সেই লক্ষ্যেই তার পাশে দাঁড়াতে স্কুলের সরস্বতী প্রতিমাও তাই এ বার কেশহীন।
এই বিশেষ সরস্বতী মূর্তি তৈরি করেছে ওই স্কুলেরই নবম শ্রেণির ছাত্র আয়ুষকুমার খটিক। আয়ুষের বানানো ছোট্ট সরস্বতী মূর্তিটি কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল। এ দিন সকালে শ্বেতা সেই মূর্তির আবরণ উন্মোচন করতেই স্কুলের পড়ুয়া থেকে শিক্ষিক-শিক্ষিকারা হাততালি দিয়ে উঠলেন। স্কুলের এক শিক্ষিকা সুমনা সেনগুপ্ত জানান, শ্বেতা যে ব্রেন টিউবারকিউলাসিসে ভুগছে, তা তাঁরা জানেন। তার খোঁজখবর নেওয়া হয় নিয়মিত। সুমনা বলেন, ‘‘আমি মাসকয়েক আগে শ্বেতাকে ফোন করেছিলাম। জানিয়েছিলাম, এ বার সরস্বতী পুজোর দিন আমাদের স্কুলের পত্রিকার উদ্বোধন হবে। ও যেন আসে। ও তখনই বলেছিল, ‘দিদি, আমি কী ভাবে আসব? আমার মাথার চুল নেই। ওষুধের জন্য সব ঝরে পড়ে গেছে।’ তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়েছিল। তখনই মনে হয়, এ বার আমাদের স্কুলের সরস্বতীকেও যদি কেশহীন করা যায়, তা হলে ওর সঙ্কোচ দূর হতে পারে। ওর লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা কেশহীন সরস্বতীর পুজো করার সিদ্ধান্ত নিই।’’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক উৎপল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই কঠিন অসুখের জন্য শ্বেতাকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে বহু দিন। এতটুকু মেয়েকে কত ওষুধ খেতে হয় সারা দিনে। তার মধ্যেও ও লড়াই থামায়নি। এত প্রতিকূলতার মধ্যে যে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি চালাচ্ছে, সেই তো আমাদের সরস্বতী। তাই ওকে দিয়েই আমরা এই মূর্তির উদ্বোধন করালাম।’’
শ্বেতার চোখেমুখে এ দিন ছিল আত্মবিশ্বাসের ছাপ। মূর্তি উদ্বোধন করে সে বলে, “হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম যখন, তখন মাথার চুল উঠে গিয়েছিল। এখন তো আবার গজিয়ে গিয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, কিছু দিন ওষুধ খেলেই ভাল হয়ে যাব।’’ তবে বেশি ক্ষণ পড়লে মাথা ধরে যায়, জানাল শ্বেতা। সে বলে, ‘‘শুক্রবার থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শুরু হচ্ছে। টানা বেশি ক্ষণ পড়তে পারি না। মাথা যন্ত্রণা করে। একটু পড়ে বিশ্রাম নিই। তার পরে আবার পড়ি। মা সব সময়ে পাশে থাকে।’’
স্কুলে সরস্বতী পুজোয় মেয়ের সঙ্গে এসেছিলেন মা আশা মিশ্রও। তিনিই মেয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী। মেয়েকে রোজ স্কুলে দিয়ে যেতেন তিনিই। আশা জানান, একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে মেয়ের অসুখ ধরা পড়ে। স্থানীয় চিকিৎসককে দেখানোর পরে শ্বেতাকে আর জি কর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। তার পর থেকে সেখানেই তার চিকিৎসা চলছে।
আশা জানান, তাঁর স্বামী গাড়ি চালানোর কাজ করেন। তিনি নিজে পরিচারিকার কাজ করেন। পঁচিশ বছরের একটি ছেলেও রয়েছে তাঁদের। সামান্য রোজগারে শ্বেতার চিকিৎসার খরচ চালানোও খুব কঠিন। আশা বলেন, ‘‘মেয়ের তো পড়াশোনা করে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন। অসুখের মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই যতই টানাটানির সংসার হোক না কেন, ওর পাশে তো থাকতেই হবে।”
কেশহীন মূর্তির পাশে রয়েছে একটি সাধারণ সরস্বতী প্রতিমাও। কিন্তু পুজোর দিন সবার চোখ টেনেছে ওই কেশহীন সরস্বতীই। সুমনা বলেন, “নবম শ্রেণির পড়ুয়া আয়ুষ খুব সুন্দর মূর্তি তৈরি করতে পারে। এক বার মাটি দিয়ে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতার আদলে মূর্তি বানিয়েছিল। ওকেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুই পারবি চুল ছাড়া সরস্বতী বানাতে?’ ও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়।“ নিজের তৈরি মূর্তি স্কুলে দেখে খুব খুশি আয়ুষ। সে বলে, “আগে কোনও দিন সরস্বতীর মূর্তি বানাইনি। মাথায় চুল নেই সরস্বতীর। তবু এটাই সেরা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy