প্রতীকী ছবি।
স্বামী-স্ত্রী মিলে স্থির করেছিলাম, পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে এ বার নতুন সদস্যকে আনার সময় হয়েছে। সেই পরিকল্পনায় গত এক মাসে যে এত ধাক্কা আসবে, ভাবিনি। মা তো হওয়া হয়নি আমার, উল্টে জটিল অস্ত্রোপচারে বাদ গিয়েছে একটি ফ্যালোপিয়ান টিউব। এর এক সপ্তাহের মধ্যে সেলাই কাটিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরতেই ধুম জ্বর। গোটা পরিবার সংক্রমিত!
বাদ যাননি আমার বছর ষাটেকের মা-ও। তবে প্রথম সন্তান হারানোর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেও কিন্তু লড়াই ছাড়িনি। এক মাসের এই কঠিন সময় কাটিয়ে মনে হচ্ছে, করোনার সঙ্গে এই লড়াই অবশ্যই জেতা সম্ভব। রোগ না লুকিয়ে প্রথমেই চিকিৎসা শুরু করলে জয় হবেই। যেমন আমি, মা হতে না-পারার যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেই হারিয়েছি করোনাকে।
হাওড়ার বালিতে আমার বাড়ি। বেলুড়ের ছেলে সুরজিৎ বসাককে বছর পাঁচেক আগে বিয়ে করি। সুরজিৎ কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে কর্মরত, দিল্লি এনসিআর-এ থাকে। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার গবেষণার কাজ শেষ না হওয়ায় আমি হাওড়াতেই ছিলাম। গত বছর গবেষণা শেষ করে মাকে নিয়ে দিল্লিতে চলে যাই। এর পরেই সন্তান নিয়ে পরিকল্পনা করি দু’জনে। গত মার্চে অন্তঃসত্ত্বাও হই।
কিন্তু কয়েক দিন যাওয়ার পরেই পেটে এক ধরনের ব্যথা শুরু হয়। আমার দাদা-বৌদি দু’জনেই চিকিৎসক। বৌদি একজন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক। ইউএসজি করাতেই তিনি এক রকম নিশ্চিত হন যে, আমার ‘এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি’ হয়েছে। অর্থাৎ ইউটেরাসে তৈরি না হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবেই আমার জাইগোট বড় হচ্ছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। যে কোনও দিন সেই জ়াইগোট ফেটে অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যুও হতে পারে। এর পরে গত ৫ এপ্রিল রাতে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আমাকে দিল্লির একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। রাত ২টো থেকে কাতরাতে থাকলেও ভোর সাড়ে ৪টের আগে আমার অস্ত্রোপচার শুরুই করা যায়নি। করোনা রিপোর্ট ছাড়া কী ভাবে অস্ত্রোপচার হবে, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানতেন না। শেষে ভোর সাড়ে ৪টের পরে আমার রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় শুরু হয় অস্ত্রোপচার। দেড় ঘণ্টার সেই অস্ত্রোপচারে বাদ যায় আমার একটি ফ্যালোপিয়ান টিউব। সংক্রমণ এড়াতে পরের দিনই তড়িঘড়ি ওই হাসপাতাল আমায় বাড়ি
পাঠিয়ে দেয়।
যন্ত্রণা নিয়ে এক সপ্তাহ বাড়িতে কাটানোর পরে ফের হাসপাতালে গিয়ে সেলাই কাটিয়ে ফিরি। এর মধ্যে কয়েক জন আমায় বাড়িতে দেখতে এসেছিলেন। সেলাই কাটাতে যাওয়ার দিন ফোনে তাঁদেরই একজনের জ্বরের খবর পেলাম। তার দু’দিনের মধ্যেই আমার জ্বর এল। এর পরে জ্বরে কাবু হলেন আমার স্বামী এবং মা। শুরু হল করোনা পরীক্ষা করানোর লড়াই। ওই শরীরে প্রতিদিন সকাল ৭টায় হাসপাতালে যেতাম আর বেলা ১২টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে শুনতাম যে, ‘আগামী কাল আসুন’। এ ভাবেই একদিন কোনও মতে পরীক্ষা করাতে পারলাম। সে দিন ভাগ্যক্রমে প্রথম ২৫ জনের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা, তাই পরীক্ষা করাতে পেরেছিলাম।
রিপোর্ট পজ়িটিভ আসার পরে টানা ন’দিন জ্বর ছিল আমার। তখন দিল্লির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। শুধুই অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজ কানে আসত। পাশাপাশি শুয়ে আমরা গুণতাম, কতগুলো অ্যাম্বুল্যান্স গেল! মায়ের অবস্থা বেশ খারাপ হয়েছিল। তখন মনে হত, মাকে কলকাতায় রেখে এলেই বোধহয় ভাল হত! প্রতিষেধকের দু’টো ডোজ় নেওয়ার পরেও মা আক্রান্ত হওয়ায় চিন্তা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
সে সময়ে আমরা পালা করে একে অপরের খেয়াল রেখেছি। স্থির করেছিলাম, কোনও পরিস্থিতিতেই মেজাজ হারানো চলবে না। খবর দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার চিকিৎসক দাদা অবশ্য প্রথম দিন থেকেই ওষুধ শুরু করে দিয়েছিলেন। সদ্য অস্ত্রোপচারের পরে যে সমস্ত ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, তা-ও বন্ধ করতে হয়। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের ১৪ দিন পরে অবস্থা
ভাল হতে শুরু করল। কিন্তু এখনও আমরা প্রত্যেকেই খুব দুর্বল। আগের নিয়মেই প্রোটিন সমৃদ্ধ খাওয়াদাওয়া চালিয়ে যাচ্ছি। এটুকু বুঝেছি, করোনা থেকে সেরে ওঠা মানেই কিন্তু নিয়ম অগ্রাহ্য করা নয়। নিয়মমতো খাওয়াদাওয়া তো করতেই হবে, সেই সঙ্গে আগের মতোই কড়া করোনা-বিধিও মেনে চলতে হবে।
এখনও দিল্লিতে হাহাকার চলছে। তবু বলব, লড়াইয়ের এই ক’দিনে শিখেছি, নিয়ম মানলে আর পাঁচটা রোগের মতো করোনাকেও হারানো সম্ভব। দিল্লি তো বটেই, গোটা দেশ খুব দ্রুত করোনাকে হারিয়ে উঠবে। শুধু মা হতে না-পারার পরেও যেমন আমি হাল ছাড়িনি, তেমনই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সকলকে শক্ত হাতে হালটা ধরে থাকতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy