দক্ষিণ কলকাতায় আত্মঘাতী ১২ বছরের শিশু, কাঠগড়ায় মানসিক চাপ। নিজস্ব চিত্র
ফুটবলে তুখড়। ঘরভর্তি ট্রফি। সম্প্রতি ডাক পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল সাব জুনিয়র টিমেও। কিন্তু পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল না তেমন। সেই নিয়েই গঞ্জনা শুনতে হত স্কুলে-বাড়িতে। সম্ভবত সেই অভিমানেই গলায় মায়ের শাড়ি জড়িয়ে আত্মহত্যা করল বাঘাযতীন এলাকার এক ১২ বছরের বালক। মঙ্গলবার রাতে ঘরের দরজা ভেঙে রোহন রায়ের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিত্সকরা। মানসিক অবসাদের জেরেই রোহন আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের প্রাথমিক অনুমান।
দক্ষিণ কলকাতার নাকতলা হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল রোহন। ফুটবলই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। রিলায়েন্স আয়োজিত আন্ত:স্কুল সাবজুনিয়র ফুটবল কম্পিটিশনে সেরা খেলোয়াড়ের শিরোপা পেয়েছিল রোহন। কিন্তু পড়াশোনায় অভিভাবকদের খুশি করতে পারেনি রোহন। বাড়িতে বড় দাদা থাকায়, তার সঙ্গে তুলনা টেনে খোঁটাও দেওয়া হত। পারিবারিক এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের সূত্রে খবর, দিন কয়েক আগে স্কুলেও তাকে বকাবকি করা হয়েছিল পড়াশোনা নিয়ে। স্কুলের তরফে অভিভাবকদের কাছেও অভিযোগ জানানো হয়। প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার সন্ধেতেও রোহনকে বাড়ির লোকজন বকাবকি করেছেন, এবং তা আশপাশের অনেকেই শুনেছেন।
এর পরেই দোতালায় নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় রোহন। রাত্রি ন’টা নাগাদ তাকে বারবার ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে, সন্দেহ হয় রোহনের বাবা-মায়ের। প্রতিবেশীদের সাহায্যে রোহনের দাদা দোতালার ঘরে বন্ধ দরজা ভেঙে ঢুকলে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। গলায় জড়ানো ছিল মায়ের শাড়ি। তড়িঘড়ি বাঘাযতীন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু তার আগেই সব শেষ।
আরও পড়ুন: স্কুলে আসতে দেরি, ঝালদায় বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে ‘শাস্তি’ প্রধান শিক্ষককে
আরও পড়ুন:ডেঙ্গিতে মৃত ২৩, জানালেন মমতাই
রোহনের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্যে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ রোহনের পরিবারের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
পঠনপাঠনের চাপ, অভিভাবকদের উদ্বেগ যে বহু শিশুকে অকালে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেটা মেনে নিচ্ছেন মনোবিদরা। অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (মনস্তত্ত্ববিদ) কথায়, ‘‘অত্যন্ত লজ্জাজনক ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এটি। কতটা অস্বস্তি ও বিরক্তিতে পৌঁছলে একজন শিশু এমন মারাত্মক পরিণতি বেছে নিতে পারে! কর্পোরাল পানিশমেন্টের যে বাধানিষেধ চালু রয়েছে স্কুলগুলিতে সেগুলো আদৌ মানা হয় কি? স্কুল হোক বা বাড়ি, এক জন শিশুকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা, ক্রমাগত তার ভুলগুলিকে নির্দিষ্ট করে চলা এগুলো একেবারেই নিষিদ্ধ। বাড়িতেও যদি একজন শিশু নিজেকে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে বাধ্য হয়, এর চেয়ে দুঃখের কিছু হতে পারে না। পড়াশোনা নিয়ে অহেতুক চাপ দেওয়া কমানোর পাশাপাশি তাদের বন্ধু হতে হবে, যেখানে থেকে যাচ্ছে ফাঁক, আর শিশুদের মনে সেই ফাঁক গলেই মৃত্যুচিন্তা ঢুকে প়ড়ছে।’’
বাড়িতে বাৎসল্য আর স্কুলে একই সঙ্গে স্নেহ ও শাসনের যুগলবন্দিতে যে চারাগাছের অবাধে বেড়ে ওঠার কথা, তা আরও একবার ঝরে গেল অকালে। বাবা মায়ের চাপকেই এর জন্যে দায়ী করছেন মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ও। তার কথায়, ‘‘আজকাল মা-বাবারা তাঁদের নিজেদের চাহিদা, নিজেদের অসাফল্য চাপা দেওয়ার প্রয়াস সবকিছুতেই নিজের সন্তানকে হাতিয়ার করেন। নিজে ফার্স্ট হইনি তাই চাই সন্তান ফার্স্ট হোক, আবার নিজে ফার্স্ট হয়েছি, চাই সন্তানও প্রথম হোক! এ ছাড়া পড়াশোনার বাইরে আর কোনও জগৎও নেই এখনকার শিশুদের। নাচ-গান-আঁকা শেখানোতেও একটা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি করছেন বাবা-মা-স্কুল। বারো বছর এমনিতেই খুব স্পর্শকাতর। বয়ঃসন্ধির শুরু। এ সময় মন এমনিই নরম থাকে। আর কবে বুঝব আমরা এ সব?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy