চার দেওয়ালের মধ্যেই ক্রিকেট খেলছিল মাজেদ (নাম পরিবর্তিত)। খেলতে খেলতেই বলল “আমিও একদিন আইপিএল খেলবো। সচিনের মতো ছয় মারবো।” বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির এই ছাত্রটি পড়াশোনা আর ক্রিকেটের সঙ্গে ছবি আঁকা আর নাচও শিখছে।
বছর তিনেক আগে অবশ্য অন্য জগতের বাসিন্দা ছিল এই কিশোর। থাকত বস্তিতে। আর প্রতি দিন নেশার টানে আসত শিয়ালদহ স্টেশনে। মদ থেকে ডেনড্রাইট, বাদ ছিল না কিছুই। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে স্টেশনে এক যাত্রীর মোবাইল চুরি করতে গিয়েছিল মাজেদ। তখনই সে জিআরপি-র হাতে ধরা পড়ে যায়। পুলিশ ও সরকারি দফতরের হাত ঘুরে তার ঠাঁই হয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোমে। সেখান থেকেই মাজেদের নতুন জীবনের শুরু।
মাজেদের মতোই শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশন চত্বরের বহু মাদকাসক্ত শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি। এ জন্য রেল কর্তৃপক্ষ শিয়ালদহ স্টেশনে তাদের জায়গা দিয়েছে। শিয়ালদহ স্টেশনে এখন তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই কাজ করছে। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, “স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে আমরা এই কাজ করছি। ইচ্ছে আছে আরও কিছু সংস্থাকে এই কাজে নিযুক্ত করার।”
এই কাজে নিযুক্ত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক কে বিশ্বনাথ জানালেন, মূলত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের প্রতিভা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালানো হয়। তারপর তাদের পাঠানো হয় ‘নন ফর্মাল’ স্কুলে এবং সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রথাগত স্কুলে। ভবিষ্যৎ স্বনির্ভরতার কথা মাথায় রেখে নানারকম হাতের কাজ শেখানো হয় ওই শিশু-কিশোরদের।
মাজেদের মতোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে বছর এগারোর বিশু (নাম পরিবর্তিত)। ছোট থেকে পরিবারহারা এই কিশোর স্টেশনে-স্টেশনে বেড়ে উঠেছে। ফলে নেশার দুনিয়ার খোঁজ সহজেই পেয়েছিল সে। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিশুর দায়িত্ব নিয়েছে তারা জানাল, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেই উদ্ধার করা হয়েছিল বিশুকে। তখন সে কথা বলার অবস্থায় পর্যন্ত ছিল না। পরে নেশা বন্ধ করে দেওয়ায় অসুস্থও হয়ে পড়ে। প্রায় ছ’মাস ধরে চিকিৎসা হয়। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিশুর পরিজনদেরও খোঁজ করেছিল। কিন্তু কাউকে না পাওয়ায় বিশুকে একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করা হয়। নেশা ভুলে এখন সে পড়াশোনা নিয়েই মেতেছে। সে চায়, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তত্ত্বাবধানে মাজেদ, বিশুর মতো অনেক কিশোরই এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। পড়াশোনা, খেলাধুলো, নাচ, গান আর আড্ডার দুনিয়ায় ফিরে ওদের কেউ শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, কারও ইচ্ছে গায়ক হওয়া। কেউ আবার শুধুই পড়াশোনা নিয়ে থাকতে চায়। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক মণিদীপা ঘোষ জানালেন, সুস্থ হয়ে স্বভাবিক জীবনে ফেরার পরে অনেকে বাড়ি ফিরে যেতে চায়, অনেকে থেকে যেতে চায় হোমে।
এই সব শিশু-কিশোরদের দেখভাল যথাযথ ভাবে হচ্ছে কিনা, সে দিকে নজর রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। উদ্ধার হওয়া শিশুদের তালিকা রেল পুলিশের কাছে থাকে। তাদের দেখভাল ঠিকভাবে হচ্ছে কি না জানতে প্রত্যেক সপ্তাহে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক হয়। কোনও গাফিলতি নজরে এলে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলেও জানিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। জিআরপি এবং আরপিএফের উদ্যোগে দুর্গাপুজোয় এই সব শিশু-কিশোরদের ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। বছরে দু’-তিন বার বেড়াতেও যায় ওরা। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক বলেন, “ভবিষ্যতে যাতে ওই সব শিশু-কিশোররা আরও ভাল থাকতে পারে, নজর রাখা হবে।
কাউন্সেলিং করিয়ে শিশু-কিশোরদের মূলস্রোতে ফেরানো হচ্ছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা, তা দেখতে নজরদারি।
বছরে তিন বার ঘুরতে যাওয়া এবং পুজোয় ঠাকুর দেখার সুযোগ মিলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy