ইমাম মহম্মদ সফিক কাসমি
ফুরফুরা শরিফের ত্বহা সিদ্দিকীর পরে কলকাতার নাখোদা মসজিদের ইমাম মহম্মদ সফিক কাসমি।
দু’জনেই মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় আনার জন্য সংখ্যালঘুরা ঢেলে ভোট দিলেও মমতার সরকার বিগত পৌনে চার বছরে সংখ্যালঘু উন্নয়নে বিশেষ কিছুই করেনি। “সংখ্যালঘুরা ভিক্ষা চান না। অধিকার বুঝে নিতে চান।” বলেছিলেন ত্বহা। আর কাসমি সাহেবের অনুযোগ, “সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য কী কী করেছে, তা নিয়ে বিস্তর ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে, প্রচার হয়েছে। কিন্তু আসল কাজ কিছুই হয়নি।”
ওঁদের কথা শুনে সরকারের মাথারা স্বভাবতই অস্বস্তিতে। প্রকাশ্যে তাঁরা এই অভিযোগ সরসরি খণ্ডন করছেন। যেমন মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের প্রতিক্রিয়া, “কোনও কায়েমি স্বার্থের চক্করে পড়েই এমন মন্তব্য করেছেন কাসমি সাহেব।” পুরমন্ত্রীর দাবি, তৃণমূল জমানায় রাজ্যে সংখ্যালঘু উন্নয়নে যত কাজ হয়েছে, স্বাধীনতার পরে তেমনটি আর হয়নি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও নানা সময়ে জানিয়েছেন, ক্ষমতায় আসার ছ’মাসের মধ্যেই তাঁর সরকার সংখ্যালঘু উন্নয়নের ৯০% কাজ সেরে ফেলেছে!
সরকারের রিপোর্টে অবশ্য ওঁদের দাবির সমর্থন মিলছে না। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, মুকুল রায় গত রবিবার যা বলেছেন, রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের দুই ধর্মীয় নেতার মুখে কার্যত তারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে! দিন কয়েক আগেও তৃণমূলে ‘দু’নম্বর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন যে ব্যক্তি, সেই মুকুলবাবুই সে দিন ফুরফুরা শরিফে গিয়ে সংখ্যালঘু উন্নয়নের প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মোক্ষম খোঁচা দিয়ে এসেছেন। “সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশের আশা ছিল, সরকার অন্তত প্রত্যাশার ধারে-কাছে যাবে। পেরেছে কি?” প্রশ্ন তুলেছিলেন মুকুল। উত্তরও দিয়েছেন নিজেই “পারেনি।” এমনকী, সংখ্যালঘুদের জন্য মমতা সরকারের উদ্যোগকে ‘কুমিরের কান্না’ বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক॥
এমতাবস্থায় নাখোদার ইমামের মন্তব্য স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষে অস্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন নিয়ে এ দিন কাসমি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেখানে নিজে থেকেই প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে তিনি বলেন, “মুকুল রায়ের সঙ্গে আমি একমত যে, রাজ্যে আগের সরকারের মতো বর্তমান সরকারের আমলেও সংখ্যালঘুদের কোনও উন্নতি হয়নি। অনেক উদ্বোধন হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।” তাঁর বক্তব্য, “কথা আর কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকছে।”
পাশাপাশি বৈষম্যের অভিযোগও তুলেছেন নাখোদার ইমাম। তাঁর দাবি: সংখ্যালঘু চাকরিপ্রার্থীদের নাম অন্যায় ভাবে প্যানেল থেকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে, পরিবর্তে চাকরি হচ্ছে অন্যদের। কাসমির হুঁশিয়ারি, “মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ না-করলে কিংবা চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা না-বললে সামনের ভোটে (পুরসভা) ও বিধানসভা ভোটে সরকারের ক্ষতি হয়ে যাবে।”
এমন নানা ‘অবিচার’ সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী কেন তৎপর হলেন না, ইমাম সে প্রশ্নও তুলেছেন। “মুখ্যমন্ত্রী হয়তো সমস্ত ঘটনা জানতেন না। কিন্তু নেতাজি ইন্ডোরের এক অনুষ্ঠানে আমি ওঁর হাতে একটা লিখিত কাগজ দিয়ে আর্জি জানিয়েছিলাম, এসএসসি-র বিষয়টি যেন বিবেচনা করেন। তার পরেও কেন তিনি কোনও পদক্ষেপ করলেন না?’’ প্রশ্ন কাসমির। ইমামের পর্যবেক্ষণ, “মুখ্যমন্ত্রী যদি সব জেনেও কিছু না করে থাকেন, তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।” কাসমি এ দিন আক্ষেপ করে বলেন, “বাম আমলে মুসলিমরা সমাজের প্রান্তে চলে গিয়েছিল। এই সরকারের আমলে আমাদের মনে আশা জেগেছিল। কিন্তু এখন উদ্বোধন হচ্ছে, ফলাও করে বিজ্ঞাপনও ছাপা হচ্ছে। অথচ কাজ হচ্ছে না!”
ত্বহা সিদ্দিকী বা সফিক কাসমি শুধু নন। বছর দুই আগে আর এক মুসলিম ধর্মীয় নেতা ক্বারী ফজলুর রহমানও সংখ্যালঘু উন্নয়ন প্রসঙ্গে মমতা সরকারের দাবি প্রকাশ্যে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। ঈদের নমাজের পরে রেড রোডের সমাবেশে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “জঙ্গলমহল, পাহাড় বা সিঙ্গুর সমস্যার সমাধানে রাজ্যের নতুন সরকার যে তৎপরতা দেখিয়েছে, সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে তা চোখে পড়ছে না।” তিনি সে দিন হুঁশিয়ারিও দেন, “আগের সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য বিস্তর প্রতিশ্রুতি দিয়েও কাজ করেছিল সামান্য। তাই তাদের ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয়েছে। এই সরকারও একই পথে চললে তাদের দরজা দেখিয়ে দিতে বেশি সময় লাগবে না।”
মমতা সরকারকে ‘দরজা দেখানোর’ সেই রাস্তা খুঁজতেই মুকুল এ বার সংখ্যালঘু তাস নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন বলে দলীয় নেতাদের অনেকের অভিমত। ভোট-ভাগের অঙ্কের যুক্তি দেখিয়ে তাঁদের বক্তব্য: পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের অন্তত ১২৫টিতে সংখ্যালঘু সমর্থনের গতি-প্রকৃতির উপরেই ভোটের ফলাফল নির্ভর করে। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে গড়ে এক চতুর্থাংশই সংখ্যালঘু ভোট, যা উপেক্ষার সাহস কোনও দল দেখাতে পারে না। রাজনীতির কারবারিরা আরও বলছেন, অতীতে সংখ্যালঘু ভোট বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাম্প্রতিক উত্থানের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘুরা কার্যত একজোটে বিজেপি-বিরোধী কোনও দলকে ঢেলে ভোট দিচ্ছেন।
এবং রাজ্যে গত কয়েকটি ভোটে সংখ্যালঘু ভোটের সেই দাক্ষিণ্য তৃণমূলই পেয়েছে। সারদা কেলেঙ্কারি-সহ দুর্নীতির নানা অভিযোগ নিয়ে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করেও বিরোধীরা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। “মুকুল রায়ও অঙ্কটা জানেন। যদি তিনি আলাদা দল গড়েনই, তা হলে সংখ্যালঘু ভোটকেই নিঃসন্দেহে পাখির চোখ করবেন।” মন্তব্য এক তৃণমূল নেতার।
রাজ্যে সংখ্যালঘু উন্নয়নের ছবিটা ঠিক কী রকম?
পৌনে চার বছরে মমতা সরকারও যে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে বড়াই করার মতো কিছু করেনি, দিল্লিতে পাঠানো রাজ্যের রিপোর্টে তা স্পষ্ট। নবান্ন-সূত্রের খবর: কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকে পেশ করা ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১২-’১৩ অর্থবর্ষে শুরু হওয়া দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মাল্টি সেক্টরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এমএসডিপি)-এ পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ১১৩৭ কোটি টাকা। ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যের হাতে এসেছে ৯৩৩ কোটি, যার ৬০% সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর এখনও খরচই করে উঠতে পারেনি!
সুতরাং তথ্যের ভিত্তিতেই সংখ্যালঘু উন্নয়নের ‘জোয়ার’ সংক্রান্ত মুখ্যমন্ত্রীর দাবির বাস্তবতা ঘিরে সংশয় রয়েছে বিভিন্ন মহলে। মুকুল রায় যখন সেটি উস্কে দিলেন, ঠিক তখনই নতুন করে সংখ্যালঘু ধর্মীয় নেতাদের ক্ষোভ প্রকাশকে রাজনৈতিক নিরিখে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই অনেকে মনে করছেন। যদিও সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী গিয়াসুদ্দিন মোল্লার মন্তব্য, “কে কী বলেছেন জানি না। শুনতে চাই না। সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে এখানে যা হচ্ছে, দেশের কোথাও হয়নি।”
উল্টো দিকে আক্রমণ শানিয়েছেন বিরোধীরা। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের সংখ্যালঘু দফতরের প্রতিমন্ত্রী আবদুস সাত্তারের দাবি, “আমাদের সময়ে সংখ্যালঘু উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশের এক নম্বরে। তৃণমূলের আমলে সব শেষ হয়ে গেল!” বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “সাচার কমিটির রিপোর্ট জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাতে মুসলিমরা ভাল আছেন। নরেন্দ্র মোদী সংখ্যালঘু উন্নয়নে যে টাকা রাজ্যকে দিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো তা খরচ করতে পারছেন না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy