প্রতীকী চিত্র।
কার্তিকী চতুর্দশীর দু’দিন আগেই নতুনবাজারে ধোয়া, বাছা, বাঁধার পর্ব সুসম্পন্ন। বরাবরের মতো। ‘গাছফর্দ মিলিয়ে সব নিয়েছি’, ফোনটা পেয়ে তবু শশব্যস্ত মার্বেল প্যালেসের কর্তামশাই হীরেন মল্লিক। ‘‘রিকশা নিস বাবা! করোনার সময়ে ভিড়ে হাঁটিস না! এ শাক হল ওষধি।’’ সাবধানে শুদ্ধাচারে রান্নাঘরে শাক পৌঁছনোর আশ্বাস দিয়ে আবার একচোট ধাতানি খাবেন কর্মচারীটি। হীরেনবাবু বকুনি দেন, ‘‘রান্নাঘর নয় রসুইঘর বল! গৃহদেবতা জগন্নাথদেবের ভোগরাগের পাকশালে কাঠের আঁচের আগুন শুধু। স্টোভ-গ্যাসের ছোঁয়াচ নেই! রসুইঘর এর নাম!’’
বচ্ছরকার চেনা দৃশ্য! তবে শাস্ত্রমাফিক চোদ্দো শাকের নাম জানতে চাইলে গৃহকর্তারা অস্বস্তিতে পড়েন। সে-কালের শাক কি আর মেলে গো! শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের কৃষ্ণশৃঙ্গারে ভোগ-আরতির অপূর্ব গান, পিলু রাগে ঠুংরির সুরে বাঁধা। শাস্ত্রজ্ঞ পুরোহিতমশাই শম্ভুনাথ স্মৃতিতীর্থ থেকে নবদ্বীপের সুশান্ত ভটচাজ্জি মশাইয়ের স্মৃতিতেও রঘুনন্দনের প্রাচীন শ্লোকের সুর। শাস্ত্র, পুরাকথার চোদ্দো শাক শুধু ভূভারতে খুঁজে পাওয়ার জো নেই।
ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসন্দি, নিম, জয়ন্তী, শালঞ্চী, হিঞ্চা, পটলপত্র (পলতা), শুলফা, গুড়িচী (গুলঞ্চ), ভণ্টাকী (ঘেঁটু), শুষনি... রঘুনন্দনের এই ফর্দ এ কালে কোথাও মিলবে না। অনেক শাক পুরুতমশাইরাও জন্মে দেখেননি। একদা পাড়ার ফ্রক বা শাড়িপরা দিদিদের পিছু পিছু গ্রাম্য দিঘির পাড়ে মুগ্ধ চোখে চোদ্দো শাক কুড়নো বালকেরাও পরপারে বিলীন। বাঙালির পুকুর মরাই, সব্জি বাগান জংলা ডুরে শাড়ি টাঙানো বাড়ির ছবিটাও শহুরে সাড়ে তিন হাত জমির ফ্ল্যাটে ফিকে। তবু কালীপুজোর আগে ভূতচতুর্দশী আসে! চোদ্দো শাকের আকুতি ছড়ায় শহরগ্রামের বাজারে।
আরও পডুন: দিনের ব্যস্ত সময়ে প্রায় ১০০% ট্রেন চালাতে সহমত রাজ্য-রেল
চোদ্দো শাক
ওলং কেমূকবাস্তুকং সর্ষপং কালঞ্চ নিম্বং জয়াং শালঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শৌলফং গুড়ূচীন্ত থা। ভণ্টাকীং শুনিষণ্ণকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।।
(ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসন্দি, নিম, জয়ন্তী, শালঞ্চী, হিঞ্চা, পটলপত্র (পলতা), শুলফা, গুড়িচী (গুলঞ্চ), ভণ্টাকী (ঘেঁটু), শুষনি)
সূত্র: রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব
শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রবীণ কর্তা অলককৃষ্ণ দেবের মেয়েরা এ বার বলে দিয়েছেন, খবরদার চোদ্দো শাক আনাবে না! কী দেয়, কে জানে! ঘাসপাতা, দুব্বো, কপির পাতা যা খুশি মেশানো। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় হাসছিলেন, ‘‘আমাদের শৈশবের চোদ্দো শাক সত্যি ছিল। এখন কী-সব মিশিয়ে গোছা বাঁধে। তবু কিছু সংস্কার ফেলতে পারি না!’’ বাবুদের লিস্টিতে মোটামুটি পালং, লাল শাক, কলমি, সর্ষে, মুলো, পুঁই, মেথি, পাট, ছোলা, হিঞ্চে, নটে, কুমড়ো, পলতা, সুষনিদের রমরমা। রঘুনন্দনের গ্রন্থ বলেছে, চতুর্দশীতে
সময়মতো এ শাক খেলে প্রেতলোকে যেতে হবে না! পুরুতমশাইদের ব্যাখ্যা, ‘‘১০০% সায়েন্টিফিক! শাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।’’ হীরেনবাবুর বিশ্বাস, আয়রন, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি-র জোগান, সুগার, প্রেশার, হাঁপানি পেটে কেঁচোর মোকাবিলা অন্তত চোদ্দো রকম অসুখের ধন্বন্তরী চোদ্দো শাকের তেজে। শাস্ত্রসম্মত রন্ধনের লক্ষ্যে, হীরেনবাবু এখনও বাঁকুড়ার বড়ি আনান। শাক যত্নে বাছাই করিয়ে তেল, হলুদ, পাঁচফোড়ন, বড়ি, বেগুন, বোঁটাবিহীন কাঁচা লঙ্কাযোগে অপূর্ব আস্বাদন। উল্টোরথে জগন্নাথদেবের শয়ন আরতির আগে ছাপ্পান্ন ভোগেও চোদ্দো শাকের উপস্থিতি। তিথির ফেরে কার্তিকের চতুর্দশী অবশ্য এ বার কালীপুজোর দুপুরেই পড়েছে। করোনাকালে তাই ধন্দ,
কালীপুজোয় উপোস করব? না রোগ তাড়াতে শাক খাব? ডাক্তারবাবু কুণাল সরকার অবশ্য বলেন, ‘‘কত ওষুধেও ভেষজ উপাদান থাকে। শাকের নানা গুণাগুণ আয়ুর্বেদে। তবে পাথুরে প্রমাণের অভাবটাও স্পষ্ট।’’ রাজারহাটের আবাসনে ঠেলাগাড়িতে আনাজ নিয়ে হাজির মহেন্দ্র সিংহ গোছা বাঁধা চোদ্দো শাকের নাম বলতে ঢোঁক গেলেন। শাক চেনা ও গোনা কঠিন। তবু আমবাঙালি হযবরল-রীতিতে হিসেব মেলায়। সাত, থুড়ি শাক দু’গুণে চোদ্দো...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy