কোর্ট থেকে বেরোচ্ছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
‘‘আমি তো নিজে (মামলা) সরাচ্ছি না। এটা সুপ্রিম কোর্টের অর্ডারে হচ্ছে। সেটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। একটা ডিসিপ্লিন তো আছে। সুপ্রিম কোর্ট এই দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্ট অর্ডার দিয়েছে, তা মেনে নিতে হবে। এতে যার যত মন খারাপই হোক, ব্যক্তিগত ভাবে যদি কারও হয়ে থাকে, সেখানে বিশেষ কিছু করার নেই।’’
সাংবাদিকদের অজস্র প্রশ্নের মুখে এটা তাঁর শুরু।
মাঝখানে— ‘‘এ দিন যে যুক্তিতে মামলা সরেছে, নিয়োগ দুর্নীতির অন্য মামলাও সেই যুক্তিতে সরে যেতে পারে।’’
আর শেষ? ‘‘সুপ্রিম কোর্ট যুগ যুগ জিয়ো। এ ছাড়া আমি কী বলব!’’
এই বলে শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার পরে কলকাতা হাই কোর্ট চত্বর ছেড়ে এ দিনের মতো বেরিয়ে গেলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তার পরে বাড়ি ঢোকার মুখে সারা দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘‘আজ তো আমার মৃত্যুদিন।’’
এ দিন দুপুরের আগেই তাঁর কাছ থেকে প্রাথমিকে নিয়োগে দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি মামলা সরিয়ে নিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। তার পরে মামলার নথি দেখতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেলকে যে নির্দেশ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় দিয়েছিলেন, সন্ধ্যায় বিশেষ বেঞ্চ বসিয়ে তাতেও স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সেই খবর যখন ছড়িয়ে পড়ে, বিচারপতি তখন হাই কোর্টে। শুক্রবার রাত ৯টা নাগাদ দেখা যায়, কলকাতা হাই কোর্ট চত্বর শুনশান। বেশির ভাগ আলো নিভে গিয়েছে। আলো জ্বলছে একটি মাত্র ঘরে। আদালতের খবর, কোর্টের নতুন ভবনে নিজের চেম্বারে রয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ঘরেই আলো। এর কিছুক্ষণ পরেই বেরোন বিচারপতি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে যেমন বলেছেন, ‘‘আমি ইস্তফা দেব না। আমি পালিয়ে যাওয়ার লোক নই,’’ তেমনই বলেছেন, ‘‘মামলা আমি ব্যক্তিগত ভাবে করিনি। তাই আমি বিচার করব না অন্য কেউ, তা নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই। আমি বিচারপতির পদে থাকি বা অন্য কোনও পদে, দুর্নীতির বিরোধিতা করব।’’
তাঁর কাছ থেকে নিয়োগ দুর্নীতির সংশ্লিষ্ট মামলা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ শুনে ভেঙে পড়েছেন অসংখ্য চাকরিপ্রার্থী। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় রাতে বলেন, ‘‘অপেক্ষা করুন। মামলা শেষ হয়নি। এর পরে যিনি শুনবেন তিনিও এক জন হাই কোর্টের বিচারপতি।’’ তবে দিনভর চর্চা আরও উস্কে দিয়েছে তাঁর পরের মন্তব্য, ‘‘... এর পরে যিনি বিচারপতি আসবেন, তিনি তাঁর স্টাইলে কাজ করবেন। আমি যে কাজ ছ’মাসে করছিলাম সে কাজ করতে গিয়ে ৬০ বছর লেগে গেলেও আমার কিছু বলার নেই। সুপ্রিম কোর্টেরও কিছু বলার নেই।’’
পরে সল্টলেকে বাড়িতে ঢোকার সময় ফের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর উপরে ‘কোনও রাজনৈতিক চাপ’ ছিল না এবং রাজনীতির সঙ্গে ‘সম্পর্ক নেই’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘একটি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। তা সুপ্রিম কোর্ট ঠিক মনে করেনি। তবে ঠিক কী বলেছিলাম তা নির্দেশে স্পষ্ট নয়।’’ আগামী সোমবার থেকে আগের মতোই বিচারপতির চেয়ারে বসবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট তো আমার চরিত্র বদল করতে বলেনি।’’
কলকাতা হাই কোর্টের ১৭ নম্বর এজলাস (ওই ঘরেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মামলা শোনেন)-এর ভিতরে এবং তার বাইরে এ দিন বেলা বাড়তেই জমতে শুরু করেছিল ভিড়। গোটা প্রথমার্ধ কেটেছে বিচারপতির প্রতীক্ষায়। দ্বিতীয়ার্ধেও তিনি বসবেন কি না, সেই প্রশ্ন যখন জোরদার, তখন দুপুর প্রায় আড়াইটে নাগাদ এজলাসে ঢোকেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তার পরেই কোর্টের অফিসারকে ডেকে নির্দেশ অনুলিখনের নির্দেশ দেন। জানা যায়, তাঁর সাক্ষাৎকারের যে অনুবাদ (ট্রানস্ক্রিপ্ট), তাঁর রিপোর্ট এবং কলকাতা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের যে রিপোর্ট দেখে সুপ্রিম কোর্ট মামলা সরানোর নির্দেশ দিয়েছে, সেগুলি তিনি ‘স্বচ্ছতার খাতিরে’ দেখতে চান। সুপ্রিম কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেলকে ওই নথিগুলির আসল প্রতিলিপি রাত ১২টার মধ্যে পেশ করতে হবে বলে নির্দেশও দেন নিজের আসনে বসে। জানিয়ে দেন, সেই রিপোর্টের জন্য রাত সওয়া ১২টা পর্যন্ত তিনি ওই এজলাসেই বসে থাকবেন।
এ দিন সিবিআইয়ের সিট বা বিশেষ তদন্তকারী দল-এর এক সদস্যের স্বেচ্ছাবসরের আর্জির শুনানি ছিল। কিন্তু সেই সিট প্রাথমিক নিয়োগ মামলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তার শুনানি এ দিন করেননি বিচারপতি। এজলাসে তখন থিকথিকে ভিড়। সবাই চেয়ে রয়েছেন বিচারপতির দিকে। তিনি নিশ্চুপ। এর কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের চেম্বারে যাওয়ার জন্য তিনি আসন থেকে ওঠেন। তখনই তাঁকে হালকা সুরে বলতে শোনা যায়, “তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষকে আমার প্রণাম। ওঁর ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গিয়েছে। উনি এত বড় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা আমি জানতাম না।” প্রসঙ্গত বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে সুপ্রিম কোর্ট মামলা সরিয়ে দেবে, সে ব্যাপারে আগেভাগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কুণাল। আর বিচারপতির এই মন্তব্য শোনার পরে কুণাল পাল্টা বলেন, “আমার তরফ থেকেও প্রণাম, শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা রইল। ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। পদের অপব্যবহার করে দল, দলের নেতা ও দলনেত্রী সম্পর্কে তিনি কিছু অবাঞ্ছিত মন্তব্য করেছেন। এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা মামলার সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং ওই চেয়ারে বসে করা যায় না। রাজনৈতিক ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া অংশটুকুর বিরোধিতা করেছি।” পরে রাতেও বিচারপতি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “অবশ্যই ফলে গেল (ভবিষ্যদ্বাণী)। আমি খুব আশ্চর্য অথবা আমি একেবারেই আশ্চর্য নই।”
আদালত সূত্রের খবর, চেম্বারে ফিরে সুপ্রিম কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেলের জবাবের জন্য সেখানেই মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষার পরিকল্পনা করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু, প্রতিলিপি পাঠানোর জন্য তাঁর নির্দেশ সন্ধ্যায় স্থগিত করে সুপ্রিম কোর্ট।
হাই কোর্ট ভবনের একটি ঘরে আলো তার পরেও জ্বলছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy