মাদ্রিদ শহরের বিশাল পার্কে মুখ্যমন্ত্রীর সকাল-সফর। —নিজস্ব চিত্র।
সকাল ১০টায় মাদ্রিদ শহরের বিশাল পার্কে স্বাস্থ্যান্বেষী ভিড়। বিভিন্ন বয়সের লোকজন দৌড়চ্ছেন। হাঁটছেন। সাইকেল চালাচ্ছেন। রাস্তার পাশে এমনকি, লোহা-তোলা জিমও করছেন। তাঁদের পরনে ঝলমলে ফ্লুরোসেন্ট রঙের পোশাক। দেখলে চোখে ধাঁধা লাগে। মনে হয়, পৃথিবীটা এত স্বাস্থ্যবান?
কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যেও কেউ কেউ থমকে গেলেন শাড়ি-পরিহিতা এক মহিলাকে জগিং করতে দেখে! কেউ কেউ এসে মোবাইলে ছবিও তুলতে শুরু করে দিলেন। পায়ে হাওয়াই চটি। মাথার চুল আঁট করে বাঁধা। পরনে সাদা সুতির শাড়ি। জগিংয়ের সময় দু’টি হাত দেহের সমান্তরালে ওঠানামা করছে। কপাল, গলা, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে নামছে স্বেদবিন্দু। কে বলবে তিনি ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী!
দেশে তো বটেই, বিদেশে এলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁটার রুটিনে ছেদ পড়ে না। বাঁ হাতের মণিবন্ধে বাঁধা ফিটনেস ট্র্যাকারে অন্তত ১০,০০০ ‘স্টেপ’ না হলে মন খুঁতখুঁত করে তাঁর (লক্ষ্য অবশ্য থাকে ২০ থেকে ৩০,০০০ পদক্ষেপ। না হলে অন্তত ১০,০০০)। তা বৃহস্পতিবার স্পেনীয় সময় সকাল ১০টার কিছু আগে তিনি বেরোলেন হাঁটার জন্য। সঙ্গী তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা, পুলিশের তিন বড় কর্তা, সাংবাদিক এবং কয়েক জন শিল্পপতি। রাস্তা পেরিয়ে বিশাল পার্কে পৌঁছে দ্রুত গতিতে হাঁটতে শুরু করলেন মমতা।
মাদ্রিদে আসার পথে দীর্ঘ বিমানযাত্রার কারণে দু’দিন হাঁটা হয়নি। সেই ঘাটতি পোষাতেই কি তিনি শাড়ি পরেই খানিক জগিংও করে নিলেন? হতে পারে। হতে পারে আশপাশের দৌড়বাজদের দেখে তাঁরও ইচ্ছা হয়েছিল খানিক দৌড়তে। নিজেই বললেন সকলকে, ‘‘এ বার একটু জগিং করি!’’ বলেই গায়ের চাদরটা (মাদ্রিদের আকাশ সকাল থেকে মেঘলা। হাওয়ায় খানিক হিম হিম ভাব) খুলে নিজের নিরাপত্তারক্ষীর হাতে দিয়ে বলা নেই, কওয়া নেই দৌড়পায়ে রওনা দিলেন সামনের দিকে।
বিদেশে গিয়ে এর আগেও হেঁটেছেন মমতা। তবে জগিং এই প্রথম। তাঁর ঘনিষ্ঠমহলের বক্তব্য, ইদানীং তিনি হাঁটার সঙ্গে জগিংও করে থাকেন। তবে খোলা রাস্তায় নয়। আর বিদেশে তো নয়ই। সে অর্থে মাদ্রিদ পার্কের সকাল-সফর খানিকটা বেনজিরই হয়ে রইল।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যাঁরা হাঁটা শুরু করেছিলেন, তত ক্ষণে তাঁদের অনেকেই পিছিয়ে পড়েছেন। পাল্লা টানছেন সত্যম রায়চৌধুরী, মেহুল মোহানকা এবং সঞ্জয় বুধিয়া। খানিক দূরে তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা, সাগর দরিয়ানি, শুভঙ্কর সেন, কমল মিত্তল, রমেশ জুনেজা (তাঁদের কি কিঞ্চিৎ হাঁপ ধরেছিল?)। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সকলের সম্পর্কেই সজাগ। হাঁটতে হাঁটতে এবং দৌড়তে দৌড়তেও খোঁজ নিচ্ছিলেন, কারা কত দূরে রয়ে গেলেন।
হাঁটতে হাঁটতেই আবার তৃণমূলের সংসদীয় দলকে নির্দেশ দিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে বিল নিয়ে সংসদে জোরালো ভাবে আপত্তির কথা জানাতে। বললেন, আগে যেন ভাল করে বিলটা পড়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশিই যেন যোগাযোগ করা হয় ‘ইন্ডিয়া’র সহযোগী দলগুলোর সঙ্গে, যাতে সংসদের ভিতরে সকলে এককাট্টা হয়ে ওই বিলের বিরোধিতা করা যায়। ঝাড়খণ্ড থেকে অপরাধীরা আসছে সীমান্ত পেরিয়ে সন্নিহিত জেলায়। তাদের সম্পর্কে সতর্ক করলেন মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহ-অধিকর্তা মনোজ বর্মাকে (প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী মাদ্রিদের পার্কে কোন রাস্তায় হাঁটবেন, সাতসকালেই গিয়ে তা ঠাহর করে এসেছিলেন তাঁর নিরাপত্তার মুখ্য অধিকর্তা, এসপিজি-র প্রাক্তন সদস্য পীযূষ পাণ্ডে এবং মনোজ। মনোজের সঙ্গে তিনিও ছিলেন হাঁটায়। যেমন ছিলেন মমতার দুই নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী স্বরূপ গোস্বামী এবং কুসুমকুমনার দ্বিবেদী)। নদিয়ার রানাঘাটে ডাকাতি রুখতে যিনি গুলি চালিয়েছিলেন, তাঁকে যাতে পুরস্কৃত করা হয়, সেই নির্দেশও দিলেন। মোবাইল অ্যাপে দেখলেন, কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টির কী হালচাল। এক বার কথা বলে নিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। সৌরভ-ডোনার সঙ্গে তাঁদের একমাত্র কন্যা সানাও এসেছেন মাদ্রিদে। তাঁদের দুপুরে আমন্ত্রণ জানালেন মুখ্যমন্ত্রী।
পৌনে দু’ঘণ্টার হাঁটা শেষে যখন বেরোচ্ছেন, তখন দেখা হল এক পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন বাজিয়ের সঙ্গে। খানিক ভাব বিনিময় হল। স্পেনীয় বাদক কী বুঝলেন কে জানে, তিনি বাদ্যযন্ত্রটি কাঁধ থেকে খুলে তুলেই দিতে চাইছিলেন মমতার হাতে। তবে তত দূর যেতে হয়নি। মমতা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েই বাজালেন ‘আমরা করব জয়’। ভাষান্তরে, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। যে গানের সুর সারা পৃথিবীতে মোটামুটি পরিচিত। ফলে কিছু কৌতূহলী ভিড়ও জুটে গেল চারপাশে।
পার্ক থেকে বেরিয়ে মমতা বললেন, ‘‘১০,৩৩৭ স্টেপ হল। হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে ১০,০০০ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।’’
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকারি কর্মসূচি। সন্ধ্যায় লা লিগার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তার আগে দুপুরে স্পেনের রাষ্ট্রদূত আসবেন দেখা করতে। মুখ্যমন্ত্রী যখন হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, তখন মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী একটি বৈঠক সেরে নিয়েছেন। স্পেন সরকারের ভাষা অধিকর্তা গুইলেরমো এসক্রিবানোর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের প্রধান সচিব বন্দনা যাদব। দু’পক্ষের বৈঠকে বাংলার ছাত্রদের স্প্যানিশ শেখানো এবং শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিদেশি ভাষা শেখার চাহিদা রয়েছে। প্রসঙ্গত, রাজ্য সম্প্রতি যে নতুন শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছে সেখানেও বিদেশি ভাষাশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কী ভাবে বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এই কাজ করা যায় সে বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে স্পেন সরকারও। রাজ্যের তরফে স্পেন সরকারের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। সব ঠিক থাকলে চলতি বছরের ২১ ও ২২ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে দুই সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘বুকসেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ড’-এর দুই কর্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এবং সুধাংশু দে-র সঙ্গে ‘মউ’ সাক্ষরিত হবে স্পেনের প্রকাশকদের সংগঠনের। বিকেলে টেম্পে গ্রুপ অফ ইন্ডিটেক্সের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করবেন মুখ্যসচিব, মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা এবং শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের প্রধান সচিব। সন্ধ্যায় মাদ্রিদে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেখা করবেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। তার পর লা লিগার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ার তেভাজ়ের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করবেন মমতা। সেই বৈঠকে থাকবেন সৌরভ, মোহনবাগান ও মহমেডানের দুই কর্তা দেবাশিস দত্ত এবং ইশতিয়াক আহমেদ। ইস্টবেঙ্গলের প্রতিনিধি এখনও মুখ্যমন্ত্রীর সফরে যোগ দেননি। জানা গিয়েছে, ১৬ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ, শনিবার ইস্টবেঙ্গল কর্তা রূপক সাহা বার্সেলোনায় মমতার সফর-দলে যোগ দেবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy