বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল মুজাহিদিন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার ছক কষছে বলে জানতে পেরেছেন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র গোয়েন্দারা।
এ দিন দিল্লিতে এনআইএ-র তিন পদস্থ কর্তা সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-সম্বলিত ডশিয়ার বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডে জামাতের হাত রয়েছে বলে আগেই জানা গিয়েছিল। খাগড়াগড়ের সেই বাড়িতে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক বানানোর অন্যতম উদ্দেশ্য যে বাংলাদেশে নাশকতা ঘটানোই ছিল, তা-ও জানা গিয়েছে তদন্তে। এ বার সরাসরি হাসিনা-হত্যার ছক সামনে আসার পরে তার সঙ্গেও বাংলায় ঘাঁটি গাড়া জঙ্গিদের যোগ আছে কি না, সে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকারও সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করছে।
বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে এনআইএ গোয়েন্দারা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছেন, ২০১১ সাল থেকেই শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ছিল মৃত শাকিল ও তার সঙ্গীরা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো ছাড়াও হাসিনার দল আওয়ামি লিগের নেতাদের হত্যার জন্য বিস্ফোরকগুলি ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। গোয়েন্দাদের মতে, গত তিন বছরে ৪ দফায় তিরিশটি করে আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) অর্থাৎ মোট ১২০টি বিস্ফোরক প্রতিবেশী দেশে পাঠানো হয়েছে। সে সব কোথায় পৌঁছেছে, সে বিষয়ে ঢাকাকে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য ইতিমধ্যে দিয়েছে ভারত। ভবিষ্যতে একটি পূর্ণাঙ্গ ডশিয়ারই দেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “এত দিন বাংলাদেশের মাটি ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার হতো বলে অভিযোগ করে এসেছে দিল্লি। এখন পাল্টা অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে উঠছে!”
প্রত্যাশিত ভাবেই এনআইএ এ দিন যা বলেছে, তার নিরিখে বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনার তাৎপর্য আরও কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতে যে ভাবে জঙ্গি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
গত কাল পশ্চিমবঙ্গ সফরের পর আজ সকালে রাজনাথের সঙ্গে বৈঠকে বসেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, ওই বৈঠকেও জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজ্যে কী ভাবে নিজেদের শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে, তার সার্বিক চিত্র রাজনাথের সামনে তুলে ধরা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “জঙ্গি রাডারে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজনাথ। তিনি অবিলম্বে জঙ্গিদের ওই নেটওয়ার্ককে চিহ্নিত করে তা নির্মূল করার নির্দেশ দেন।” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীও। তিনি অবিলম্বে এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এ দিন পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গিদের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজনাথকে দেখানো হয়, কী ভাবে গোটা অপারেশনে মহিলারা সক্রিয় ভাবে যুক্ত। ওই মহিলাদের মূলত শিমুলিয়া ও লালগোলার প্রতিষ্ঠানে জেহাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এ নিয়ে নিয়মিত ক্লাস করানো ছাড়াও অস্ত্রশিক্ষার বিভিন্ন কলাকৌশল, বিস্ফোরক বানানো এবং তার ব্যবহারও শেখানো হতো তাদের। মন্ত্রক জানিয়েছে, গোটা রাজ্যে খাগড়াগড়ের মতো ২৫টি মডিউল এক সঙ্গে কাজ করত। তবে বর্ধমান বিস্ফোরণের পর ধরপাকড়ের আশঙ্কায় তাদের কাজকর্ম আপাতত বন্ধ রয়েছে। জড়িতদের অধিকাংশই ফেরার। প্রাথমিক ভাবে তিরিশ জনের একটি দলকে চিহ্নিত করে তাদের খোঁজে তল্লাশি শুরু করেছে এনআইএ। পলাতকেরা নেপাল বা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সতর্ক করা হয়েছে দু’দেশের প্রশাসনকেও।
বর্ধমানের জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে দেশের অন্যান্য প্রান্তের জঙ্গিদের যোগাযোগও সামনে এসেছে। গত কাল ডোভালের সঙ্গে ছিলেন এমন এক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তা আজ বলেন, “ইতিমধ্যেই অসম ও চেন্নাইয়ের বিভিন্ন জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে বর্ধমানের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ মিলেছে। সব ক’টি ক্ষেত্রেই একই ভাবে কাজ করত জঙ্গিরা।” গোয়েন্দারা বিশেষ ভাবে চিন্তিত বর্ধমানের সঙ্গে অসমের যোগাযোগ নিয়ে। বর্ধমান কাণ্ডের পর বরপেটা থেকে ছ’জনকে গ্রেফতার করে অসম পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এক জনের সঙ্গে বর্ধমান কাণ্ডে মৃত এক জনের সরাসরি যোগ থাকার প্রমাণ মিলেছে।
কেন্দ্র মনে করছে, এখন সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রাথমিক ভাবে রাজ্য পুলিশের তদন্তে ঢিলেমি ছিল। বর্ধমান-কাণ্ডের মূল চক্রী শেখ কৌসর ২ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বর্ধমানেই ছিল। পরে সে নদিয়া-হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছে বলেই ধারণা গোয়েন্দাদের। তাঁদের অভিযোগ, তখন রাজ্য পুলিশ আরও সক্রিয় হলে কৌসর-সহ অন্য অভিযুক্তদের ধরা সহজ হতো।
পশ্চিমবঙ্গের এই পরিস্থিতি নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে ফের নালিশ করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও। রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও দিল্লিকে জানিয়েছেন। যদিও কেন্দ্র তা মনে করে না। তবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে বলে বার্তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
ফের হাজির এনআইএ
নদিয়ার থানারপাড়া গমাখালির জহিরুল শেখের বাড়ি গিয়ে জহিরুলের বাবা জুয়াদ আলি শেখের সঙ্গে কথা বললেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) গোয়েন্দারা। মঙ্গলবার এনআইএ-র গোয়েন্দারা থানারপাড়া থানায় এসে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে জহিরুলের বাড়িতে যান। জুয়াদ জানান, জহিরুলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ১০ অক্টোবর জহিরুলের বাড়ি থেকে ৪১টি জিলেটিন স্টিক উদ্ধার করে সিআইডি। তার পর থেকে জহিরুলের বাড়িতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের যাতায়াত লেগে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy