—প্রতীকী ছবি।
দু’টি ঘটনা পিঠোপিঠি সময়ের। প্রথমটি কলকাতার বুকে। দ্বিতীয়টি কলকাতা লাগোয়া এক জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রথম ঘটনাটি নিয়ে আন্দোলনের যে ‘ঝাঁজ’ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল, তেমনটা দেখা যায়নি দ্বিতীয় ঘটনায়। প্রথম ঘটনাটি আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন। দ্বিতীয়টি দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের কৃপাখালি গ্রামে এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুন। শুক্রবার ‘বিচার’ পেল জয়নগর। কিন্তু আরজি করের মামলা এখনও আদালতে বিচারাধীন। প্রত্যাশিত ভাবেই জয়নগরের ক্ষেত্রে ‘প্রাপ্তি’ এবং আরজি করের ক্ষেত্রে ‘অপ্রাপ্তি’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশিই ফেলে আলোচিত হচ্ছে সিবিআইয়ের ‘ভূমিকা’ এবং রাজ্য পুলিশের ‘তৎপরতা’র কথা।
জয়নগরের ঘটনায় দু’মাসের মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়াকে স্বভাবতই তাদের ‘সাফল্য’ হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছে রাজ্য পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত কম সময়ে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করে দোষীকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়েছেন।
আরজি করের ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধেই তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ উঠেছিল। টালা থানার প্রাক্তন ওসি সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে। তীব্র আন্দোলনের মুখে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। যে পুলিশ আরজি করে হয়ে উঠেছিল ‘খলনায়ক’, জয়নগরের ঘটনায় সেই পুলিশকেই নায়কের মর্যাদা দেওয়ার ভাষ্য তৈরি শুরু হয়েছে শাসকদলের তরফে। কারণ, জয়নগরে পুলিশই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে চার্জশিট তৈরি করেছিল। বিচারপ্রক্রিয়া চলেছিল ফাস্ট ট্র্যাক পকসো আদালতে। যার নেপথ্যে ছিল পুলিশের ‘সক্রিয়তা’। সেই সূত্রেই শাসকদল এবং পুলিশের একাংশ জোরালো দাবি তুলতে শুরু করেছে এই মর্মে যে, কলকাতা পুলিশের হাতে তদন্তভার থাকলে আরজি কর মামলারও বিচার সম্পন্ন হয়ে যেত (বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে বিচারের কথা বলেওছিলেন)।
জয়নগরের ঘটনার ৬১ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে বারুইপুর আদালত। শুক্রবার ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেন বিচারক সুব্রত চট্টোপাধ্যায়। অন্য দিকে, আরজি করের ঘটনার ১২০ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। ১১ নভেম্বর থেকে নিম্ন আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তা খুব দ্রুত শেষ হবে বলে মনে করছে না কোনও পক্ষই। পৃথক মামলা রয়েছে সুপ্রিম কোর্টেও। আরজি করের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পাশাপাশি ওই হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাও চলছে আদালতে। যা মূল মামলার সঙ্গে কার্যত সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে।
জয়নগর মামলায় নিম্ন আদালতে এত দ্রুত বিচার হল কী ভাবে? কেন আরজি করের ক্ষেত্রে তা হল না? এ নিয়ে নানা মত এবং পাল্টা মতামত রয়েছে। দেশের বিচার ব্যবস্থার ‘দীর্ঘসূত্রিতা’ নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। আরজি করের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বিরলতম। কর্মক্ষেত্রে, কর্মরতা অবস্থায় এক জন চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার অভিঘাত ছিল গভীর। কিন্তু জয়নগরে তা ছিল না। যদিও জয়নগরের ঘটনা আরও বেশি ‘নারকীয়’ বলে মনে করেন অনেকে। কারণ, সেখানে নির্যাতিতা এক জন নাবালিকা। আরজি করের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছিল কলকাতা পুলিশ। লালবাজার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করেছিল অভিযুক্তকে। চার দিনের মাথায় কলকাতা হাই কোর্ট আরজি করের তদন্তভার তুলে দেয় সিবিআইয়ের হাতে। কিন্তু সিবিআইও এখনও পর্যন্ত ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় দ্বিতীয় কাউকে গ্রেফতার করেনি। আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বক্তব্য, জয়নগরের ঘটনা ছিল আইনি পরিভাষায় ‘ওপেন অ্যান্ড শাট কেস’। কিন্তু আরজি করের ঘটনা তা নয়। তার অনেকগুলি দিক রয়েছে। তবে এর পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। তা হল, আরজি করের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। সেটাই ‘অকাট্য প্রমাণ’। তাই মূল মামলার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা খুব কঠিন বা সময়সাপেক্ষ না-ও হতে পারত।
তবে একটা বিষয় সকলেই মানছেন যে, আরজি করের ঘটনাটি জয়নগরের তুলনায় ‘জটিল’। তার অজস্র ‘শাখাপ্রশাখা’ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ওই ঘটনার সঙ্গে শাসকদলের একাংশের পরোক্ষে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও রয়েছে। তা ছাড়া, আরজি করের ঘটনা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা দেশ এমনকি, বিদেশেও অভিঘাত তৈরি করেছিল। সেই কারণেই তদন্তকারী সংস্থাকে মেপে পদক্ষেপ করতে হচ্ছে। তাদের অনেক বেশি ‘সতর্ক’ থাকতে হচ্ছে। বিলম্ব সেই কারণেই। পক্ষান্তরে, জয়নগরের মামলা তুলনায় অনেক ‘সরলরৈখিক’। নাবালিকাকে ধর্ষণ এবং খুনের পরে এলাকায় জনরোষ তৈরি হয়েছিল। ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে। ঘটনার দিন স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে আগুনও লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রুদ্ধ জনতা। তাদের সমবেত ক্ষোভের মুখে দৌড়ে পালাতে হয়েছিল পুলিশকে। কিন্তু তার মধ্যে কোনও রাজনীতি ছিল না।
নির্যাতিতার মা অবশ্য মনে করেন, এখনও সব অপরাধী ধরাই পড়েনি! শুক্রবার তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, ওটা এক জনের কাজ নয়। ওখানে আরও অনেকে ছিল। তারা এখনও ধরা পড়েনি।’’ নির্যাতিতার বাবার বক্তব্য, ‘‘ধৈর্য ধরতে হবে। এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণ এবং খুন। ঘটনাটা ঘটেছিল কর্মক্ষেত্রে।’’
আরজি কর-কাণ্ডে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের ‘অন্যতম মুখ’ কিঞ্জল নন্দ মনে করেন, আরজি করের ঘটনায় এখনও বিচার না মেলার নেপথ্যে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি বিচারাধীন থাকা এবং সিবিআইয়ের ‘শ্লথতা’। তাঁর কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি বিচারাধীন। তা ছাড়া, খুন-ধর্ষণের সঙ্গে আরও কিছু অভিযোগ রয়েছে। তবে সিবিআই যে ভাবে তদন্ত করছে, তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে।’’ আন্দোলনে অংশ নিয়ে ধর্মতলায় অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তার স্নিগ্ধা হাজরার কথায়, ‘‘আরজি করের ঘটনা ঘটেছিল হাসপাতালে। যেখানে সারা ক্ষণ পুলিশের নিরাপত্তা থাকে। ফলে জয়নগরের ঘটনার সঙ্গে আরজি করের ঘটনার কিছু ফারাক রয়েছে।’’ তিনিও জানান, তিনি বা নির্যাতিতার বাবা-মা তো বটেই, কেউই বিশ্বাস করেন না, ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার একা ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন। রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রের বক্তব্য, ‘‘আরজি করের মামলাটি জটিল। তদন্তে একের পর এক নাম উঠে এসেছে। ওই মামলার সঙ্গে পুলিশ অফিসার জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। ওই মামলায় অভিযুক্ত বা সাক্ষীর সংখ্যা অনেক বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy