টোকিও থেকে ২০ জন বিশেষজ্ঞকে উড়িয়ে এনে হলদিয়ার কারখানা বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছে মিৎসুবিশি। আগামী দু’বছর ধরে কারখানার দু’টি ইউনিটে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন করবেন এই জাপানি বিশেষজ্ঞরা। কর্তৃপক্ষের আশা, এর ফলে এক দিকে যেমন পিউরিফায়েড টেরিপথ্যলিক অ্যাসিড (পিটিএ) তৈরির খরচ কমবে, তেমনই উৎপাদন নিয়ে যাওয়া যাবে সর্বোচ্চ সীমায়। আর দুইয়ে মিলে সস্তার চিনা পিটিএ-র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে হলদিয়ার কারখানা।
কিন্তু তার পরেও যদি পিটিএ-র দেশি-বিদেশি বাজার দখল করতে না-পারে মিৎসুবিশি? সংস্থার এক কর্তার কথায়, “কারখানা বাঁচাতে এটাই শেষ পদক্ষেপ। এর পরেও পণ্যের দাম না-কমলে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকবে না। কারণ, টানা ১৫-১৬ বছরের লোকসানের ধকল নিয়ে কারখানা চালানো সম্ভব নয়।”
মিৎসুবিশি লোকসানে চলে গেল কেন? সংস্থার অন্দরের খবর, ২০০০ সালে হলদিয়ার কারখানায় প্রথম পর্যায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। গোড়া থেকেই সেখানে তৈরি পিটিএ-র গুণমানের উপরে নজর দেওয়া হয়েছিল। ফলে তার দামও বেশি হয়। সেই কারণে কী দেশীয়, কী আন্তর্জাতিক কোনও বাজারেই তেমন সাফল্য পায়নি মিৎসুবিশি। অবস্থা সামলাতে ২০০৬ সালে হলদিয়ায় দ্বিতীয় ইউনিট গড়ার কাজে হাত দেয় তারা। উদ্দেশ্য ছিল খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো। যাতে বাজার ধরা যায়। কিন্তু তত দিনে প্রবল প্রতিযোগী হিসেবে সামনে চলে এসেছে চিনা সংস্থাগুলি। তাদের তৈরি পিটিএ গুণমানে মিৎসুবিশির পিটিএ-র সমকক্ষ না হলেও দামে অনেকটাই কম। টন-পিছু প্রায় ২০ হাজার টাকা। অতএব সব ধরনের বাজারেই চিনা পণ্যের চাহিদা বাড়ে। আরও গভীর হয় মিৎসুবিশির সঙ্কট।
সংস্থার এক কর্তা জানাচ্ছেন, প্রথম দিকে হলদিয়া বন্দর থেকে দক্ষিণ এশিয়া এবং আসিয়ান দেশগুলিতে রফতানি করা হতো পলিয়েস্টার ফাইবার ও বিভিন্ন প্লাস্টিক দ্রব্যের অন্যতম কাঁচামাল পিটিএ। কিন্তু চিনা পণ্যের দাপটে সেই রফতানি ধীরে ধীরে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বাকি ছিল দেশের বাজার। তারাও ধীরে ধীরে চিনা পিটিএ কেনা শুরু করে। বাজারে টিকে থাকতে তখন উৎপাদন খরচের থেকেও কম দামে পিটিএ বিক্রি করতে শুরু করে মিৎসুবিশি। শুরু হয় লোকসান। যা বাড়তে বাড়তে এখন সংস্থার মোট সম্পদের অঙ্ককেও ছাপিয়ে গিয়েছে। ফলে বিআইএফআর-এর দ্বারস্থ হতে হয়েছে মিৎসুবিশিকে।
এখান থেকে বেরনোর উপায় কী? সংস্থার কর্তারা জানাচ্ছেন, বাজারে কম দামে মাল দিতে পারলে তবেই কারখানা বাঁচবে। সেই কারণেই সমস্ত দিক থেকে খরচ কমানোর পন্থা খোঁজা হচ্ছে। নিজস্ব জেটি তৈরি করে প্যারাজাইলিন, অ্যাসিটিক অ্যাসিড আমদানির খরচ কমানো, রাজ্যের কাছে পণ্য-প্রবেশ করে ছাড় চাওয়া, ২০০৪ সালে ঘোষিত ইনসেনটিভ স্কিমের সুযোগ নিয়ে ১৫ বছর পর্যন্ত ভ্যাট ছাড় পাওয়ার ব্যবস্থা করা তারই অঙ্গ। শ্রমিকদের পাওনা-গণ্ডার চাপও যাতে না-বাড়ে সে জন্য শ্রম দফতরের কাছে আর্জি জানিয়েছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু সরকারি সহায়তায় যে সঙ্কট সবটুকু কাটবে না, বড়জোর কিছু সুরাহা হতে পারে, তা বিলক্ষণ জানেন মিৎসুবিশি কর্তারা। সেই কারণেই শেষ চেষ্টা হিসাবে জাপান থেকে এক দল বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসে তাঁদের হাতেই উৎপাদন খরচ কমানোর ভার দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞদের মূল কাজ হল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এনে সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ উৎপাদন চালু করা। মাস তিনেক আগে হলদিয়ায় আসা জাপানি কর্তারা সেই কাজ শুরুও করেছেন বলে জানা গিয়েছে।
কী সেই কাজ?
কারখানা সূত্রের খবর, হলদিয়ার দু’টি ইউনিট চালাতে মিৎসুবিশির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন ৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ফার্নেস অয়েল জ্বালিয়ে জেনারেটর থেকে এই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। কিন্তু তার বিপুল খরচ। সেই খরচ কমাতে কারখানা কর্তৃপক্ষ এখন রাজ্যের থেকেই বিদ্যুৎ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সে জন্য গ্রিড পাওয়ার প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পিটিএ তৈরির জন্য প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন করতে হয়। সেই তাপমাত্রায় পৌঁছনোর জন্য এত কাল ফার্নেস অয়েল জ্বালানো হতো। এ বার খরচ কমাতে ‘কোক হট অয়েল হিটার’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জ্বালানি হিসাবে ফার্নেস অয়েলের বদলে সস্তার কোকিং কোল কাজে লাগানো হবে। সংস্থার এক কর্তা বলেন,“এখন প্রতি ইউনিট তাপশক্তি উৎপাদনে ১৩ টাকা খরচ হয়। কোকিং কোল ব্যবহার করলে সেই খরচ ৯ টাকায় নেমে যেতে পারে।” এই দুই পরিবর্তন চালু করার লক্ষ্যেই এখন কাজ করছেন জাপানি বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোও লক্ষ্য মিৎসুবিশির। সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রসারণের পর হলদিয়ার দ্বিতীয় ইউনিটে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ টন পিটিএ উৎপাদন করা সম্ভব। প্রথম দিকে তাতে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৬০-৬৫ টন পিটিএ তৈরি হতো। এক সময় তা ঘণ্টায় ৯০ টনেও পৌঁছেছিল। কিন্তু উৎপাদন কখনওই সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় ইউনিটে নানা গোলযোগের কারণে বেশ কয়েক দফায় ভুগতে হয়েছে। চলতি মাসেই ২ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত টানা ১৭ দিন ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়েছিল। উৎপাদন সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যেতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কাজও বিশেষজ্ঞরা করছেন।
মিৎসুবিশির সঙ্কট পর্বে চিনা পণ্যের প্রতিযোগিতার কথা সামনে এলেও দেশের পূর্বাঞ্চলের আর্থিক পরিস্থিতিও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। ১৫ বছর আগে মিৎসুবিশি যখন কারখানা গড়ে তখন হলদিয়াকে কেন্দ্র করে পূর্ব ভারতে পেট্রো রসায়ন শিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আভাস মিলেছিল। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, তৈল শোধনাগার এবং মিৎসুবিশির কারখানার সূত্র ধরে এই এলাকায় আরও অনেক পেট্রো রসায়ন শিল্প আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল। মিৎসুবিশির আশা ছিল, হলদিয়ার আশপাশে অনেক পলিয়েস্টার এবং পেট বোতল তৈরির কারখানা গড়ে উঠবে। তৈরি হবে বিভিন্ন ধরনের ফিল্ম তৈরির কারখানাও। ফলে তাদের পিটিএ বিক্রিতে সমস্যা হবে না।
কিন্তু গত দেড় দশকে বিশেষ বদলায়নি হলদিয়ার ছবি। মাঝে, ২০০৪-’০৫ সালে পেট্রো রসায়ন শিল্পে জোয়ার আনতে নন্দীগ্রামে মেগা কেমিক্যাল হাব তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু তৃণমূলের আন্দোলনের জেরে সেই চেষ্টা বানচাল হয়ে যায়। একই সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস। সেই পথে হেঁটেছে মিৎসুবিশিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy