Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Arjun Singh

মুকুলের পথেই অর্জুন! দুই হাতে দুই ফুল রেখেও কি বিজেপির দিকে ঝুঁকে ব্যারাকপুরের সিংহ সাংসদ?

ব্যারাকপুরে বুধবার রাতে ডাকাতি এবং এক যুবকের মৃত্যুর পরে সরব অর্জুন সিংহ। বিজেপি সাংসদ তৃণমূলে ফিরে গেলেও টানা আক্রমণ শানিয়ে চলেছেন রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে। তাতেই তৈরি হচ্ছে প্রশ্ন।

Mukul Roy and Arjun Singh.

অর্জুন-রহস্য বাড়ছে! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৩ ১৬:১৮
Share: Save:

মুকুল-ক্ষত এখনও শোকায়নি তৃণমূলের। খাতায়কলমে বিজেপি বিধায়ক মুকুল রায় এপ্রিলের মাঝামাঝি রাজ্য রাজনীতিতে হইচই ফেলে ‘চুপিচুপি’ দিল্লি গিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি বিজেপিতে ছিলেন এবং আছেন। মুখে সে কথা না বললেও তৃণমূলে ফিরে-যাওয়া অথচ খাতায়কলমে বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহও কি সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন?

ব্যারাকপুরে সোনার দোকানে ডাকাতি এবং ডাকাতদের বাধা দিতে গিয়ে তাদের গুলিতে এক যুবকের নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকেই ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন পুলিশের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। এতটাই যে, তিনি তৃণমূলের অঙ্গ কি না, তা নিয়ে শাসকদলের মধ্যেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অর্জুনকে নিয়ে জল্পনাও বাড়ছে। তবে প্রশাসনিক সূত্রের একাংশের দাবি, অর্জুন ঘাসফুল ছেড়ে আবার পদ্মফুলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়েছেন। আগামী বছর লোকসভা ভোট। তার আগে অর্জুনকে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেকে মনে করছেন, সেই জন্যই অর্জুন এখন থেকেই ‘ইঙ্গিতবহ’ মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। যদিও কেউই এর সত্যতা স্বীকার করতে রাজি হননি। প্রকাশ্যে এ নিয়ে মুখ খুলতেও কেউ রাজি নন।

২০১৯ সালে ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দিয়ে অর্জুন সাংসদ হন ব্যারাকপুর থেকে। সেই সময়েই তাঁর ছেড়ে দেওয়া বিধানসভা আসন ভাটপাড়া থেকে বিজেপির টিকিটে বিধায়ক হন তাঁর পুত্র পবন সিংহ। শোনা যায়, মুকুলেরই যোগাযোগে অর্জুন বিজেপিতে আসেন এবং মুকুলের পরামর্শেই তৃণমূলে ফেরেন। কিন্তু মুকুল যেমন পুত্র শুভ্রাংশু রায়কে নিয়ে তৃণমূলে ফিরেছিলেন, তেমনটা করেননি অর্জুন। পবন এখনও ভাটপাড়ার বিজেপি বিধায়ক এবং পুরোমাত্রায় গেরুয়া শিবিরের সঙ্গেই রয়েছেন। তেমন সুযোগ মুকুল পাননি। কারণ, শুভ্রাংশু ২০১১ এবং ২০১৬ সালে পর পর দু’বার বীজপুর থেকে তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক হলেও ২০২১ সালে পদ্মপ্রতীকে জিততে পারেননি।

মুকুল বিজেপিতে দ্বিতীয় বার যোগ দিতে দিল্লি গেলেও তাঁর সঙ্গে আদৌ গেরুয়া শিবিরের কোনও শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে অনেকেই বলেন, কলকাতা থেকে টিকিট কেটে বিমানে তুলে দেওয়া থেকে দিল্লিতে মুকুলের থাকার ব্যবস্থা— সবের পিছনেই বিজেপির এক ‘প্রভাবশালী’ নেতার হাত ছিল। যদিও রাজ্য বিজেপি এক বারও জন্য মুকুলের ‘প্রত্যাবর্তন’ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। পক্ষান্তরে, তৃণমূল ছিল আক্রমণাত্মক। মুকুলের মানসিক স্থিরতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় তৃণমূলের তরফে। যে প্রশ্ন আবার সবচেয়ে আগে তুলেছিলেন মুকুলের পুত্র শুভ্রাংশু। তখন শুভ্রাংশু এমনও দাবি করেন যে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কুৎসা করার জন্যই বিজেপি মুকুলকে দিল্লি নিয়ে গিয়েছে। শুভ্রাংশুর যে মন্তব্যকে তৃণমূল সমর্থন তো করেইনি, বরং অকারণে অভিষেকের নাম টানা ঠিক হয়নি বলে বার্তা দেয়।

মুকুলের থেকে অর্জুনের পরিস্থিতি অবশ্য আলাদা। সিংহ পরিবারের পিতা সাংসদ। পুত্র বিধায়ক। ফলে দু’জনেই পদ্মফুল বা ঘাসফুলের কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। বাবা যা-ই করুন, তাঁর পুত্র পবন এক বারের জন্যও বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেননি। পরিষদীয় দলের সব কর্মসূচি এবং দলনেতার নির্দেশ শৃঙ্খলার সঙ্গে মেনে চলেন। সাংগঠনিক বৈঠকে ডাক পেলে থাকেন। গত রবিবার কলকাতায় রাজ্য কর্মসমিতির বৈঠকেও হাজির ছিলেন পবন। তাঁর ফেসবুক পেজ দেখলে বোঝা যায়, রামনবমীর মিছিল থেকে প্রধানমন্ত্রী ১০০তম ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে যোগদান— সবেতেই রয়েছেন পবন।

পুত্র যেমন একনিষ্ঠ ভাবে বিজেপি করছেন, তখন পিতা কি তৃণমূলে ততটা একাগ্র? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেকের কর্মসূচির লাইভ ভিডিয়ো ফেসবুকে শেয়ার করলেও তাঁর নিজস্ব দলীয় কর্মসূচি তেমন দেখা যায় না। ‘দিদির সুরক্ষাকবচ’ কর্মসূচিতে ‘দিদির দূত’ হয়ে তাঁকে পুরুলিয়ায় দেখা গেলেও ব্যারাকপুরে সে ভাবে যোগ দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। এই সব কারণেই অর্জুন যখন তাঁর এলাকায় ডাকাতি এবং তাতে একজনের মৃত্যু নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের নিন্দায় ধারাবাহিক ভাবে সরব হচ্ছেন, দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তখন তাঁকে ঘিরেও তৈরি হচ্ছে প্রশ্ন।

বিজেপির একাংশের দাবি, অর্জুন ‘ব্যক্তিগত কারণে’ তৃণমূলে ফিরে গেলেও গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। সে ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে সরবও হন না। কারণ, তিনি দরজা বন্ধ করতে চান না। সেই কারণেই ছেলেকে বিজেপিতে রেখে গিয়েছেন বলেও দাবি পদ্মশিবিরের একটা অংশের। তাঁদের বক্তব্য, ব্যারাকপুরের মতো আসনে লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করার মতো নেতা বিজেপিতে এখনও পর্যন্ত কেউ নেই। তাই মুকুল বা অন্য যাঁরা দলের টিকিটে জিতেও তৃণমূলে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে অর্জুনের তুলনা চলে না।

অর্জুন নিজে অবশ্য এ সব নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চান না। এই মর্মে আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে এটা বলেছেন যে, তাঁর মন্তব্যে তৃণমূল অখুশি হলেও তাঁর কিছু করার নেই। অর্জুনের কথায়, ‘‘দল কিছু ভাবতে পারে। কিন্তু আমাকে তো মানুষ নির্বাচিত করেছে! আমায় তো মানুষের কথা বলতে হবে। তাদের নিয়েই চলতে হবে। আর ভুল তো কিছু বলিনি। যা বাস্তব সেটাই তো বলছি।’’

অর্জুন পুলিশের যে সমালোচনা করেছেন, তার পিছনেও যুক্তি রয়েছে বলে দাবি তাঁর ঘনিষ্ঠদের। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘দাদা তৃণমূলে যোগ দিলেও পুলিশ দাদার সম্পদ নয়, দায়। কারণ পুলিশ তো দাদার বিরুদ্ধেই বেশি কাজ করে। প্রচুর মামলা দিয়ে রেখেছে।’’ শুক্রবারেও অর্জুনের বক্তব্যে সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘‘যেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই, সেখানে নিজে ভিভিআইপি নিরাপত্তা নিতে লজ্জা হয়!’’ আক্ষেপের সুরে তিনি এ-ও বলেন, ‘‘ব্যারাকপুরের সাংসদ হয়ে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছি না। এ দিকে আমি নিজে ভিভিআইপি নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।’’ তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যেও ইঙ্গিত দেখছেন অর্জুনের অনুগামীরা। কারণ, অর্জুন যে ভোটে জেতার কথা বলছেন, সেটা বিজেপির হয়ে পাওয়া ভোট। হিন্দিভাষী অধ্যুষিত ব্যারাকপুরে গেরুয়া শিবিরের ভোটজমি নেহাত মন্দ নয়।

এ হেন অর্জুনকে কিন্তু বিজেপি বা তৃণমূল— কেউই সে ভাবে আক্রমণ করছে না। শাসকদলের পক্ষে মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘কোনও অনভিপ্রেত ঘটনাকে সমর্থন করা যায় না। তবে দলের একজন প্রবীণ নেতা হিসাবে অর্জুন সিংহেরও বিরোধীদের সুরে মন্তব্য করা ঠিক নয়।’’ আবার বিজেপিও খুব বেশি আক্রমণে যাচ্ছে না। কারণ, অর্জুন যে সুরে কথা বলছেন, তাতে আখেরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বিজেপিরই সুবিধা হচ্ছে বলে তারা মনে করছে।

অর্জুন কি ফিরতে পারেন বিজেপিতে? দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের জবাব, ‘‘এ ব্যাপারে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ অভিজ্ঞেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাজনীতিতে অনেক সময় ‘কোনও মন্তব্য নয়’-ও সরাসরি ‘না’ বলার চেয়ে বেশি ইঙ্গিত এবং অর্থ বহন করে।

অন্য বিষয়গুলি:

Arjun Singh TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy