গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছ’দিন আগে গ্রেফতারের পর বসিরহাট আদালত চত্বরে যে ভঙ্গিতে তাঁকে হাঁটতে দেখা গিয়েছিল, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। বন্দিদশায় অমন ‘পাহাড়প্রমাণ ঔদ্ধত্য’ অনেককেই বিস্মিত করেছিল। বুধবার সন্দেশখালির সেই শাহজাহান শেখকে সিবিআই নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার পর তাঁর যে ভাব-ভঙ্গিমা দেখা গেল, তাতে বিরোধীদের প্রশ্ন, ‘‘কোথায় গেল সে দিনের সেই তর্জনী? কোথায় গেল সেই বিক্রম!’’ কারও কটাক্ষ, ‘‘সন্দেশখালির বাঘ কি ইঁদুর হয়ে গেলেন?’’
সন্দেশখালির সরবেড়িয়ায় ইডি আধিকারিকদের উপর হামলার ঘটনায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁ থেকে শাহজাহানকে গ্রেফতার করেছিল রাজ্য পুলিশ। ওই দিন সকালে শাহজাহানকে যে ভাবে তর্জনী তুলে বসিরহাট আদালতে ঢুকতে দেখা গিয়েছিল, তা চোখে লেগেছিল অনেকেরই। বিরোধীরা প্রশ্ন তোলে, শাহজাহানের কিসের এত ‘দাপট’ যে পুলিশকর্মীরা তাঁর হাত ধরে তাঁকে এজলাসেও নিয়ে যেতে পারছেন না? ৫৫ দিন ধরে যাঁকে ‘পলাতক’ বলে এসেছে রাজ্য পুলিশ, গ্রেফতারের পর তাঁকে অমন সাদা পোশাকে, ক্লিন শেভেনে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল কারও কারও। সেই দিন শাহজাহানের ১০ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারক। পরে ওই মামলা যায় সিআইডির হাতে। তার পর থেকে রাজ্য পুলিশের সদর দফতর ভবানী ভবনেই ছিলেন সন্দেশখালির সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল নেতা।
কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর সেই শাহজাহানকে সিবিআইয়ের হাতে বুধবার তুলে দিয়েছে সিআইডি। সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে শাহজাহানকে যখন ভবানী ভবন থেকে নিয়ে বেরোলেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা, তখন অনেকটাই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ঘেরাটোপে হাত ধরে শাহজাহানকে নিয়ে গেলেন সিবিআই আধিকারিকেরা। গত ২৯ জানুয়ারির সেই শাহজাহান আর বুধবারের এই শাহজাহানের হাবে-ভাবে রয়েছে বিস্তর ফারাক! পোশাকও বদলেছে। সেই দিন পরনে ছিল ধবধবে সাদা কুর্তা আর পাজামা। বুধবার শাহজাহানের পরনে ছিল সাদা রাউন্ড কলার টিশার্ট আর কালো ট্রাউজ়ার। সিবিআই আধিকারিকেরা যখন তাঁকে গাড়িতে তুলছেন, তখন তর্জনী তোলা তো দূরঅস্ত্, খানিক আড়ষ্ট ভাব দেখা গেল তাঁর মধ্যে। ছ’দিনের ব্যবধানে এমন বদল দেখে অনেকেরই মত, শাহজাহানের আত্মবিশ্বাসে যে চিড় ধরেছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট। ভেঙে পড়েছেন তিনি! বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল বলেন, ‘‘ডারউইন বিবর্তনবাদের কথা বলেছিলেন। সেটা কি শাহজাহানের ক্ষেত্রে উল্টে গেল? সন্দেশখালির বাঘ কি ইঁদুর হয়ে গেল? এই প্রশ্ন আমি করতে চাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।’’
যদিও রাজ্য পুলিশের একাংশের মত, এমনটা নয় যে সিবিআই হেফাজতে নেওয়ার পর এই দশা হয়েছে শাহজাহানের। ভবানী ভবনে লাগাতার জেরার মুখেই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। শুরুর দিকে তদন্তকারীদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন। কিন্তু পরে অবিরাম প্রশ্নের মুখে তখনই ভেঙে পড়েছিলেন। প্রাথমিক ঔদ্ধত্য ছিল এটা ভেবে যে, দল তাঁর পাশে আছে। নেতা-নেত্রীর হাত থাকবে মাথায়। কিন্তু সিআইডির পোড় খাওয়া তদন্তকারীদের একের পর এক প্রশ্নবাণ এবং তাঁদের আচরণ থেকে যখন বুঝতে পারেন যে, তাঁর অবস্থান আর পাঁচ সাধারণ অভিযুক্তের মতোই, তখন থেকেই বিধ্বস্ত হতে শুরু করেছিল তাঁর চোখ-মুখ। বুধবার শাহজাহানের যে ছবি দেখা গেল, তা সিআইডির তদন্তকারীদের জেরা সামলাতে না পারারই ফল।
গত ৫ জানুয়ারি রেশন মামলার তদন্তে সন্দেশখালির সরবেড়িয়ায় শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে আক্রমণের মুখে পড়তে হয় ইডি আধিকারিকদের। সেই ঘটনায় ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে শাহজাহান গ্রেফতার হওয়ার পরেই শাসক তৃণমূল তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করে ছ’বছরের জন্য। হাই কোর্টের নির্দেশে সেই ঘটনার তদন্ত এখন সিবিআইয়ের হাতে। মঙ্গলবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিল, শাহজাহানকেও সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে হবে। ওই নির্দেশ পাওয়ার পর পরই ভবানী ভবনে পৌঁছে যান সিবিআই আধিকারিকেরা। কিন্তু প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষার পর শাহজাহানকে না-নিয়েই ফিরতে হয় তাঁদের। পরে জানা যায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য। বিষয়টি বিচারাধীন হয়ে যাওয়ায় হাই কোর্টের নির্দেশ পালন করা হয়নি।
কিন্তু বুধবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, প্রয়োজনে প্রধান বিচারপতির কাছে এ নিয়ে আবেদন জানাতে পারে রাজ্য। আপাতত হাই কোর্টের নির্দেশই বহাল থাকছে। অন্য দিকে, রাজ্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় ইডি। বুধবার বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, বিকেলেই সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে হবে শাহজাহানকে। তার পর ভবানী ভবনে পৌঁছে যায় সিবিআই। সঙ্গে ছিল সিআরপিএফ। দীর্ঘ সময় ধরে চলে সেই হস্তান্তরের প্রক্রিয়া।
শাহজাহানকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে প্রথমে তাঁকে জোকা ইএসআই-তে নিয়ে যান তদন্তকারীরা। সেখানে মেডিক্যাল পরীক্ষার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিবিআইয়ের দফতর নিজ়াম প্যালেসে। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, বুধবার রাতেই শাহজাহানকে একপ্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন গোয়েন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy