গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বঙ্গভোটের আগে চিটফান্ড-কাণ্ডে ফের সক্রিয় সিবিআই। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া পিটিশনে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার স্পষ্ট ইঙ্গিত, বহু ‘রাঘববোয়াল’ এখনও নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছে। এ বার তাদের নাগাল পেতেই কি নতুন করে উদ্যোগ নিতে চাইছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা? বিধাননগর এবং কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে নিজেদের হেফাজতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই-এর আবেদনের পর, সেই জল্পনা আরও জোরালো হচ্ছে।
সিবিআইয়ের পিটিশনে অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে কুণাল ঘোষের দেওয়া জবানবন্দির কথা। সিবিআইয়ের দাবি, সুদীপ্ত-র দু’টি মোবাইল খতিয়ে দেখা গিয়েছে, তাঁর এবং কুণালের মধ্যে এক বছরে ৩০৬ বার কথা হয়েছে। (অ্যানেক্সচার- সি-১০)
তা ছাড়া সারদার ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্য কর্মীদের দেওয়া স্বীকারোক্তিরও উল্লেখ করা হয়েছে পিটিশনে।
আরও পড়ুন: এ বার সুদীপ্ত সেনের ২১ পাতার চিঠি নিয়ে হাজির কুণাল ঘোষ
আরও পড়ুন: মোদীর হাতে বাংলা তুলে দেওয়াটাই তাঁদের আসল লক্ষ্য, বললেন শুভেন্দু
আনন্দবাজার ডিজিটালের হাতে থাকা এই পিটিশনের কপি অনুযায়ী কুণালের জবানবন্দি ছিল, সারদা এবং অ্যালকেমিস্ট গ্রুপ ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছিল। এর নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তৎকালীন তৃণমূল (বর্তমানে বিজেপি) নেতা মুকুল রায় এবং প্রাক্তন পুলিশ কর্তা রজত মজুমদারের। কুণাল দাবি করেন, প্রায় ২০৫ জন প্রার্থীকে ২৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়। (অ্যানেক্সচার-সি-১১)
সারদা-কাণ্ডে মুখ খোলার পরই ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর বিধাননগর পুলিশ কুণালকে গ্রেফতার করে। এ বিষয়টিও সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সিবিআই। এই ঘটনাটি ‘বৃহত্তর ষড়ষন্ত্র’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তথ্য লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে দেবযানীকে নিয়ে যাওয়া হয় বেশ কয়েকবার। দুই ট্রাঙ্ক ভর্তি নথিপত্র উদ্ধার হয়েছিল বলে সিবিআইয়ের দাবি। তাতে মিডিয়া সংস্থা এবং ‘সেলস ডিড’ ছিল। ল্যাপটপ, কম্পিউটারের ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস-ও দেবযানী তুলে দিয়েছিলেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের কাছে। কিন্তু সেই তথ্য ছিল না পুলিশের ‘সিজার লিস্টে’। সিবিআইয়ের দাবি, তাতে অনেক প্রভাবশালীর নাম ছিল যাঁরা সারদার বিভিন্ন বৈঠক এবং কর্মিসভায় যেতেন। এদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতারা যেমন ছিলেন, তেমন সরকারি অফিসারেরাও ছিলেন। সেই সব তথ্য ইডি-কেও দিয়েছিলেন দেবযানী। (অ্যানেক্সচার সি-৮)
সারদা তদন্তে রাজ্য সরকার ‘স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম’ গঠন করার পর, কী ভাবে ‘তথ্য গোপন করা হয়েছিল’ তারও উল্লেখ করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া পিটিশনে। অসহযোগিতার নেপথ্যে রাজীব কুমারকে বিশেষ ভাবে দায়ী করা হয়েছে।
২০১২-২০১৫ সালের মধ্যে দু’টি চিটফান্ডেরই রমরমা বাড়তে থাকে বলে তথ্য দিয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এর দায় পুলিশ কর্তারা এড়াতে পারেন না বলে মনে করছে সিবিআই। —ফাইল চিত্র।
বিধাননগরে ‘লকার রহস্য’ এবং ‘লাল ডায়েরি’ নিয়ে রাজ্য পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার মধ্যে টানাপড়েন কম হয়নি। তা-ও উল্লেখ্য করা হয়েছে পিটিশনে। সিবিআই জানাচ্ছে, মামলা সংক্রান্ত ‘সিজার মেমো’ চাওয়া হলেও, তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তৎকালীন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার পল্লবকান্তি ঘোষকে (সিট-এর সদস্য) জেরা করা হলেও, তাঁর কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তদন্তে সাহায্য করেননি বিধাননগর কমিশনারেটের আরও অনেকে।
স্ত্রী পিয়ালি সেনের সঙ্গে সুদীপ্তর জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল বিধাননগরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিলে তা ‘ফ্রিজ’ করা হয়। ওই মাসের ১৯ তারিখ ইডি সেখানে তল্লাশি চালাতে গেলে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু তার কিছু দিন পরে, ২২ এপ্রিল রাতে (দু’বার ) ইডি অফিসারদের অনুপস্থিতিতে সেখানে তল্লাশি চালায় বিধাননগর পুলিশ।
সারদা তদন্তে অসহযোগিতার নেপথ্যে রাজীব কুমারকে বিশেষ ভাবে দায়ী করা হয়েছে। —ফাইল চিত্র।
শুধু রাজীবই নয়, পুলিশ-প্রশাসনের আরও কয়েকজনের ভূমিকাও খতিয়ে দেখার আবেদন জানানো হয়েছে। ১৬০ সিআরপিসি-তে নোটিস পাঠানো হলেও বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ, দিলীপ হাজার, শঙ্কর ভট্টাচার্যের মতো পুলিস অফিসারদের থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ।
সারদা, রোজভ্যালির তদন্তে নেমে রাজ্যে প্রায় ২৭০টি চিটফান্ড কোম্পানির হদিশ মেলে। তার মধ্যে সারদার ২৪৫০ কোটি টাকা এবং রোজভ্যালির ১৭,৩৬৭ কোটির দুর্নীতি সামনে আসে। এই দুটো কোম্পানি ছিল বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে। ২০১২-২০১৫ সালের মধ্যে দু’টি চিটফান্ডেরই রমরমা বাড়তে থাকে বলে তথ্য দিয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এর দায় ওই পুলিশ কর্তারা এড়াতে পারেন না বলে মনে করছে সিবিআই।
২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের সোনমার্গ থেকে গ্রেফতার করা হয় সুদীপ্ত এবং দেবযানীকে। সারদা গ্রুপের বিরুদ্ধে এফআইআর হয় ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখ। ওই মাসের ২৬ তারিখ রাজ্য সরকারের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়, চিটফান্ড তদন্তে সিট গঠন করা হয়। এই সিটের সদস্য ছিলেন রাজীব কুমার। সিবিআই সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশে রাজীব কুমারকে তদন্তে সহযোগিতা করতে বলা হলেও, শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে জামিনে রয়েছেন রাজীব।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে যেমন একাধিক তথ্য কোর্টের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনই সরাসরি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল-এর তরফে সারদার একটি মিডিয়া সংস্থাকে টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধরনের চিটফান্ড সংস্থাকে কেন মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। কলকাতা পুলিশের তরফে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সিবিআইয়ের ডিএসপি এবং তাঁর পরিবারকে হেনস্থা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ জানানো হয়েছে। এর পর একাধিকবার রাজ্য সরকারকে চিঠি লিখে সহযোগিতার কথা বলা হলেও, তাতে কাজ হয়নি বলে অভিযোগ সিবিআইয়ের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy