অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
রাজ্যসভার প্রার্থিতালিকার মধ্য দিয়ে কি আগামী বছরের লোকসভার প্রার্থী কেমন হবে, সে বিষয়েও ‘ইঙ্গিত’ দিয়ে রাখলেন তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব? দলের অন্দরের খবর— একেবারেই তাই। রাজ্যসভার প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে অতীতের মতো কোনও ‘বিশিষ্ট’ নামের দিকে ঝোঁকেনি তৃণমূল। নবীন যে তিন জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব এবং আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু সে অর্থে ‘সামাজিক প্রতিষ্ঠা’ নেই। অর্থাৎ, তৃণমূলে মিঠুন চক্রবর্তী, যোগেন চৌধুরী বা জহর সরকারদের দিন অতীত। দলের এক প্রথম সারির নেতা যাকে সোমবার বর্ণনা করেছেন, ‘দিশাবদল’ বলে। তাঁর কথায়, ‘‘এটা একেবারেই নতুন দিশায় পথচলা। তৃণমূলের এখন আর অলঙ্কারের প্রয়োজন নেই।’’
বস্তুত, দলের একটি বড় অংশ মনে করছে, এই প্রার্থিতালিকার মাধ্যমে আগামী বছর লোকসভা ভোটের প্রার্থী কেমন হবে, তা নিয়েও স্পষ্ট ‘ইঙ্গিত’ দিয়ে রাখল দল। অর্থাৎ, যাদবপুরে মিমি চক্রবর্তী বা বসিরহাটে নুসরত জাহান টিকিট পাবেন কি পাবেন না, সেই বিষয়েও ভাবনার অবকাশ তৈরি হল। বা ভাবনাচিন্তার ‘সঙ্কেত’ দিয়ে রাখা হল। লোকসভায় তৃণমূলের এখন চার জন ‘তারকা সাংসদ’ রয়েছেন। মিমি-নুসরত ছাড়াও সাংসদ দেব এবং শতাব্দী রায়। এঁদের মধ্যে দু’বারের সাংসদ দেব ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর আর ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছা নেই। আর শতাব্দী এখন ‘নেত্রী’ বেশি। ‘অভিনেত্রী’ কম। ফলে তাঁদের দু’জনকে নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু দলের একটি অংশ মনে করছে, মিমি এবং নুসরতকে নিয়ে ভাবনাচিন্তার পরিসর তৈরি হয়েছে।
অনেকেই মনে করছেন, রাজ্যসভার এই প্রার্থিতালিকায় তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গত, অভিষেক নিজে সংসদীয় রাজনীতিতে ‘রাজনীতিক’-দেরই প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘উনি পার্ট টাইম রাজনীতিকের পক্ষে নন। উনি চান, যিনি রাজনীতি করবেন, তিনি সর্বক্ষণের জন্যই রাজনীতি করবেন।’’
লক্ষণীয়, তৃণমূল রাজ্যসভায় আবার মনোনয়ন দিয়েছে ডেরেক ও’ব্রায়েন, দোলা সেন এবং সুখেন্দুশেখর রায়কে। প্রথম জন রাজ্যসভায় দলের নেতা। একদা খ্যাতনামী ‘কুইজ় মাস্টার’ হলেও এখন কুইজ়ের সঙ্গে তাঁর যোজন দূরত্ব। দোলা শ্রমিক ফ্রন্টের নেত্রী। তিনিও পুরোদস্তুর রাজনীতিক। সুখেন্দুশেখর রাজ্যসভায় ‘নির্বাক’ সদস্য নন। তদুপরি তিনি দলের মুখপত্রের সম্পাদকও বটে। তৃণমূল বাদ দিয়েছে শান্তা ছেত্রী এবং সুস্মিতা দেবকে। দলীয় সূত্রের খবর, তাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁদের ‘কাজ’ নিয়ে দলীয় নেতৃত্ব সন্তুষ্ট না-হওয়ায়। সংসদের উচ্চকক্ষে যে পুরনো তিন জনকে তৃণমূল ফের পাঠাচ্ছে তাঁরা সারা বছর ‘সক্রিয়’ থাকেন। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘ওঁদের মধ্যে কোনও ফাঁকিবাজি নেই।’’
তিন প্রবীণের সঙ্গে রাজ্যসভায় টিকিট দেওয়া হয়েছে তিন ‘নবীন’ সামিরুল ইসলাম, প্রকাশ চিক বরাইক এবং সাকেত গোখলেকে। সামিরুল বামপন্থী মনোভাবাপন্ন (অনেকে তাঁকে ‘নকশালপন্থী’ও বলছেন। যদিও তার কোনও সত্যতা মেলেনি)। এর আগে ভোটের রাজনীতি না-করলেও ‘রাজনীতি সচেতন’। সংগঠনের কাজ করেন। অসমর্থিত সূত্রের খবর, ডেউচা পাচামিতেও তিনি ‘গঠনমূলক’ ভূমিকা পালন করেছেন। তদুপরি সামিরুল শিক্ষিত। নিজে অধ্যাপনা করেন। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, ফুরফুরা শরিফের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ রয়েছে। যে সূত্রে অনেকে বলছেন, সামিরুলকে আনা হল নওশাদ সিদ্দিকির ‘মোকাবিলা’ করতেও। তাঁদেরই বক্তব্য, লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল যে রাজ্যসভায় একটি মুসলিম মুখ পাঠাবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সেটি যে সামিরুল হবেন, তা প্রায় কেউই ভাবতে পারেননি।
প্রকাশ চা বলয়ের আদিবাসী মুখ। তাঁর টুইটার হ্যান্ডলের ‘কভার’-এর ছবিটি অভিষেকের ‘নবজোয়ার যাত্রা’র পোস্টারের। তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এভং অভিষেকের ছবি রয়েছে। প্রকাশ আলিপুরদুয়ারের জেলা তৃণমূল সভাপতিও বটে। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মূর জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন এই আদিবাসী নেতা। আদিবাসীদের মধ্যে বিজেপির ‘প্রভাব’ খর্ব করতে প্রকাশকে মনোনয়ন দিয়ে আদিবাসী সমাজকে ‘বার্তা’ দেওয়া হয়েছে বলেই তৃণমূল সূত্রের খবর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঘটনাচক্রে তৃণমূল যশোবন্ত সিন্হাকে সমর্থন করেছিল। বিজেপি তার পরে দ্রৌপদীর নাম ঘোষণা করে। কিন্তু তখন আর মমতার পক্ষে দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতির নাম সমর্থন করার উপায় ছিল না। সেই সূত্রে বিজেপি বার বার তৃণমূলকে আক্রমণ করেছে। অনেকে মনে করছেন, সেই ‘রাজনৈতিক’ কারণেই প্রকাশকে রাজ্যসভায় পাঠাচ্ছে তৃণমূল।
তৃতীয় নবীন সাকেত জাতীয় স্তরে ‘মোদী-বিরোধী’ মুখ হিসেবে নিজেকে খানিকটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঘটনাচক্রে, সাকেতকে মোদীর রাজ্য গুজরাতের পুলিশ গ্রেফতার করেছিল রাজস্থানের জয়পুর বিমানবন্দর থেকে। সেই অর্থে সাকেতের মনোনয়নও ‘রাজনৈতিক’। দ্বিতীয়ত, সাকেত ডেরেকের খুবই ‘আস্থাভাজন’।
প্রসঙ্গত, রাজ্যসভায় প্রার্থী করার বিষয়ে অনেক দলই রাজনৈতিক পরিসরের বাইরের মানুষদের গুরুত্ব দেয়। শুধু অবামপন্থী দল নয়। বামেদের ক্ষেত্রেও সে কথা সমান প্রযোজ্য। বাম জমানায় ব্যবসায়ী বাড়ির সদস্য সরলা মহেশ্বরীকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। মমতাও একদা সে পথে হেঁটেছেন। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি এখন বদলে গিয়েছে। অনেকের মতে, নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতাকে রাজ্যসভা থেকে ইস্তফা দিতে বলার মধ্য দিয়েই এই ‘দিশাবদল’-এর শুরু হয়েছিল।
লোকসভার প্রার্থিতালিকাতেও এই ধারা অক্ষুণ্ণ থাকলে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটেও তার ‘ছাপ’ পড়বে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে গত বিধানসভায় যে তারকাদের তৃণমূল প্রার্থী করেছিল, তাঁরা ‘সক্রিয়’ বলেই দল মনে করছে। জুন মালিয়া, সোহম চক্রবর্তী, রাজ চক্রবর্তী, লাভলি মৈত্র, অদিতি মুন্সি, কাঞ্চন মল্লিকেরা এখন তৃণমূলের বিধায়ক। গায়ক ইন্দ্রনীল সেন তো মন্ত্রীও। বাঁকুড়া বিধানসভায় হেরে যাওয়ার পরেও সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সক্রিয়’। পঞ্চায়েত ভোটেও ধারাবাহিক ভাবে প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। তবে এঁদের নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় এখনও রয়েছে। আপাতত লোকসভার প্রার্থিতালিকার দিকে তাকিয়ে দলের নেতা-কর্মীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy