বেঙ্গল অম্বুজা এলাকার সেই স্পা। ছবি: বিকাশ মশান।
ছোটবেলা থেকে মামারবাড়ি যাতায়াতের সুবাদে কল্যাণী ছিল তাঁর খুব প্রিয় জায়গা। বাঁকুড়া ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে সেখানে উঠে যেতে চেয়েছিলেন। ফ্ল্যাট কেনা হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছু আসবাবপত্রও। কিন্তু সেই নতুন ফ্ল্যাটে আর যাওয়া হল না ঠিকাদার বিপুল রায়চৌধুরীর।
বাঁকুড়ার প্রতাপবাগানের বাড়িতে বসে এ সব কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বিপুলবাবুর মামাতো বোন নন্দিতা সরকার। বাড়ির ভিতরে দুই সন্তানকে আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন নিহত ঠিকাদারের স্ত্রী ইলোরাদেবীও। ১০ জুলাই ফ্ল্যাটের কাজকর্মের জন্যই কল্যাণী গিয়েছিলেন বিপুলবাবু। নন্দিতাদেবীর বাড়িতেই ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে নিজেই গাড়ি চালিয়ে বাঁকুড়া রওনা হন।
নন্দিতাদেবী বলেন, “বেরোবার আগে দাদা বলল, আমি যেন মিনিট দশেক অন্তর ফোন করি। সমানে ফোন করছিলাম। কথাও হচ্ছিল। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ বলল দুর্গাপুর পেরোচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে।’’ এর পরে আর কেউই যোগাযোগ করতে পারেনি বিপুলবাবুর সঙ্গে। শনিবার ধানবাদ থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে আনে পুলিশ। তাঁকে খুনে জড়িত অভিযোগে দুর্গাপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ জনকে।
বিপুলবাবুর প্রতিবেশী-পরিজনেরা যেমন বাক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন, ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়েছেন দুর্গাপুরে জাতীয় সড়কের পাশে নব ওয়াড়িয়ার বাসিন্দা তথা দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী জয়দেব সেন। বছরখানেক আগে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে তাঁদের বাড়ির একতলাটি ভাড়া নেয় দীপ মল্লিক ও ডলি মল্লিক। দীপ একটি সংস্থায় ও ডলি একটি বিউটি পার্লারে কাজ করে বলে দাবি করেছিল। জয়দেববাবুরা জানান, ওই দু’জনের আচার-আচরণে সন্দেহজনক কিছু পাননি তাঁরা। দু’জনেই সকালে বেরিয়ে যেত, রাতে ফিরত। ডলির বাপের বাড়ির লোক পরিচয় দিয়ে মাঝে-মধ্যেই কয়েক জন একটি গাড়িতে চড়ে আসা-যাওয়া করত। ডলি মাঝে-মধ্যে দীপকে ‘আসলাম’ নামেও ডাকত। বিপুলবাবুকে খুনে জড়িত অভিযোগে শনিবার সকালে বাঁকুড়ার পুলিশ নব ওয়াড়িয়ার ওই বাড়ি থেকে ওই দু’জনকে গ্রেফতার করে। জয়দেববাবু বলেন, ‘‘আমরা বিন্দুমাত্র কিছু বুঝতে পারিনি! সব শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, এই ডলিই শ্রাবণী মণ্ডল নামে দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে বেঙ্গল অম্বুজা এলাকার এক প্রান্তে ওই স্পা খুলেছিল। সেটির মালিক অবশ্য ওই এলাকারই বাসিন্দা সুদর্শন প্রসাদ (ওরফে সরাফত আলি, খুনের ঘটনায় ধৃতদের অন্যতম)। রবিবার গিয়ে দেখা যায়, স্পা বন্ধ। ওই বাড়িও বন্ধ। তার মালিকের দেখা মেলেনি। আশপাশের বাসিন্দারা জানান, মাস দেড়েক আগে ঘরভাড়া নিয়ে এই স্পা তৈরি হয়। প্রয়োজনীয় অনুমতি না মেলায় তা চালু হয়নি। তবে অফিসঘর খুলত রোজই। শ্রাবণী নিয়মিত আসতেন। যাতায়াত ছিল সুদর্শনেরও। শনিবার সকালে সেখানে হানা দেয় বাঁকুড়ার পুলিশ।
ওই এলাকাতেই সুদর্শনের একটি আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিন জিনিসপত্রের দোকান রয়েছে। যে বাড়িতে দোকানটি রয়েছে, তার মালিক জানান, মাস ছয়েক আগে ঘর ভাড়া নিয়ে দোকান চালু করে সুদর্শন। কিন্তু গত কয়েক মাসের ভাড়া বকেয়া। ইদানীং ফোনেও সুদর্শনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না বলে জানান তিনি। শনিবার সকালে বেঙ্গল অম্বুজা এলাকা থেকেই সুদর্শনকে ধরে পুলিশ।
অভিযুক্তদের গ্রেফতারের পাশাপাশি শনিবারই ধানবাদে বিপুলবাবুর দেহ উদ্ধারে যায় পুলিশ। সঙ্গে গিয়েছিলেন বিপুলবাবুর বন্ধু রাজু দেব। এ দিন তিনি বলেন, “পুলিশ প্রথমে আমাদের আধপোড়া দেহের ছবি দেখাল। তার পরে দেহ দেখলাম। এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, প্রাণোচ্ছ্বল মানুষটা আর নেই। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।” বিপুলবাবুর আর এক পরিচিত বাসুদেব মুসিব বলেন, “প্রথমে ওঁর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। আস্তে-আস্তে বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায়ই ফোনে গল্প হত। ঘটনাটা মানতে পারছি না।” বিপুলবাবুর প্রতিবেশী দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “পাড়ায় এক সঙ্গে আড্ডা দিতাম আমরা। খুব হাসিখুশি ছেলে ছিল। এই ধাক্কা কী ভাবে ওর পরিবার সামলে উঠবে, জানি না!’’
শনিবার রাত ২টো নাগাদ বিপুলবাবুর দেহ যখন প্রতাপবাগানের বাড়ির সামনে আনা হয়, তাঁর বহু বন্ধুবান্ধবই ছুটে এসেছিলেন। অর্ধদগ্ধ দেহটি যে সেই হাসিখুশি বিপুলবাবুর, অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। গোটা এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। ইলোরাদেবীর চোখের জল বাগ মানছে না। বাবাকে খুঁজছে আট বছরের ইমন, আড়াই বছরের মিঠিও। বাবা যে আর কখনও ফিরবে না, তা বুঝতে হয়তো আরও অনেকটা সময় লাগবে তাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy