৫০, ৫৫ থেকে একলাফে ৬০ হাজার। বইমেলা যত এগিয়েছে, ভিড় বেড়েছে। —নিজস্ব চিত্র।
ঢং ঢং ঢং... । বচ্ছরকার বিষাদমাখা অপেক্ষা রেখে বইমেলা শেষের ঘণ্টা পড়ল। এ বারের মতো বইপ্রেমীদের ‘বাৎসরিক উৎসবে’ ইতি! তবে ৪৬তম বইমেলার ভিড়ের পাশেই ‘তারকা’ হয়ে উঠল ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো। শহরের নতুন গতি। কলকাতা শহর হোক বা শহরতলির মেলামুখী স্রোতের ভেলা হয়ে ভিড় বাড়াতে এ বার গ্রিন মেট্রোই উৎসবে বাড়তি আনন্দের অনুঘটক।
৫০, ৫৫ থেকে একলাফে ৬০ হাজার। বইমেলা যত এগিয়েছে, শেয়ার বাজারের সূচকের মতোই লাফিয়ে ভিড় বেড়েছে মেট্রোয়। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে মেলা প্রাঙ্গণে উপচে পড়েছে বইপ্রেমীদের জমায়েত। বারাসত, বনগাঁ, হাবরা, সোনারপুর, বারুইপুর, বজবজের মতো শহরতলির বাসিন্দাদের বাঁদুড়ঝোলা হয়ে বইমেলায় পা রাখার দিন শেষ। বরং, শহরতলি থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ স্টেশনে নেমেই পাশে মেট্রোর গেটে ছুটেছেন উৎসাহীরা। গন্তব্য— করুণাময়ী স্টেশন। সেখানে থেকে বেরোলেই সামনে বইমেলার ৮ ও ৯ নম্বর গেট। কেনাকাটি বা ঘোরাঘুরির পর মেলা থেকে বেরোতেই সামনে বাসের সারি। পছন্দের বইবোঝাই ব্যাগপত্র সামলে তাতে চেপে উঠে সোজা বাড়ি তো যাওয়াই যায়। গিয়েছেনও অনেকে। তবে বহু মানুষ ফিরতি পথেও বেছেছেন গতির মেট্রোকে।
শহরতলির থেকে আসা বহু যাত্রীর মতে, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর জন্য বইমেলায় যেতে কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা সময় বেঁচেছে তাঁদের। ৪৬তম বইমেলার জন্য গোড়া থেকেই অতিরিক্ত ট্রেন চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। বইমেলার কথা মাথায় রেখে দৈনিক ১০৬টি ট্রেনের বদলে সোম থেকে শনিবার ১২০টি ট্রেন চালানো হয়েছে। মেট্রোর মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র জানিয়েছেন, সপ্তাহের অন্যান্য দিনের পাশাপাশি রবিবার দুপুর ১২টা ৫০ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মেট্রো চলেছে। তাতেই ‘তারকা’র তকমা কেড়ে নিয়েছে মেট্রো। একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে কৌশিক জানান, শনিবার কলকাতা মেট্রোর গ্রিন লাইনের কামরায় উঠেছিলেন ৬৬,০০০ যাত্রী। ভিড়ের নিরিখে যা আজ পর্যন্ত নজির! কৌশিক বলেন, ‘‘বইমেলাকে বছরের অন্যতম স্মরণীয় ইভেন্ট করার জন্য কেবলমাত্র শহর ও শহরতলির বইপ্রেমীদের কথা মাথায় রেখে এই প্রথম ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরে রবিবারও মেট্রো পরিষেবা শুরু করা হয়েছে।’’
মেট্রো কর্তৃপক্ষের এই প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। বইমেলাকে ঘিরে প্রায় প্রতি দিনই আগের থেকে ভিড় বেড়েছে। যা গিয়ে জমেছে বইমেলায়। ৮ ফেব্রুয়ারি, বুধবার এই মেট্রোয় ভিড় হয়েছিল ৫৫ হাজার। তার কিছু দিন আগে যা ছিল ৫০ হাজারে। তবে শনিবার সেই সংখ্যাও ছাপিয়ে গিয়েছে।
শিয়ালদহ থেকে সেক্টর ফাইভের মাঝে করুণাময়ী স্টেশনে নেমেই বইমেলায় ঢুকে পড়ার সুবিধার জন্যই যে চলতি বছর ভিড় বেড়েছে, তা মনে করছেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। বইমেলার শেষ দিনে রবিবার সন্ধ্যায় চরম ব্যস্ততার ফাঁকে মেট্রোকে তাঁর দরাজ সার্টিফিকেট! আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘মেট্রোই গেম চেঞ্জার! গত বছর বইমেলায় ২৩ লক্ষের ভিড় হয়েছিল। তবে এ বছর এখনও পর্যন্ত তা ২৫ লক্ষ হয়ে গিয়েছে। আজ (রবিবার) যা ভিড় হয়েছে তাতে ২৬ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছি। আশা করি আগামী বছর আরও বাড়বে।’’ বিক্রিবাটার নিরিখেও সফল বইমেলা। ত্রিদিবের দাবি, ‘‘চলতি বছর ২৬ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। গত বার ২৩ কোটির বিক্রি ছিল।’’
সপ্তাহের ব্যস্ত সময়ে অফিসকাছারি বা স্কুল-কলেজ সেরে বইমেলায় পা রাখলেও থিকথিকে ভিড় চোখে পড়েছে। আবার সপ্তাহান্তে হাতে কয়েক ঘণ্টা নিয়ে গেলেও নানা প্রকাশনীর স্টলের বাইরে বিপুল জমায়েত। বইপ্রেমী অনিন্দিতা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গত সপ্তাহে বইমেলায় গিয়েছিলাম। তবে সপ্তাহের মাঝেও বিকেল সাড়ে ৫টার পর থেকে আনন্দ বা দে’জ় পাবলিশার্সের মতো স্টলগুলিতে লম্বা লাইন। কম করে আধ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। সপ্তাহান্তেও শুনেছি, ৪৫ মিনিট দাঁড়াতে হচ্ছে। ছোট প্রকাশনীর স্টলেও প্রচণ্ড ভিড়।’’
মেট্রোর বাহন হাতে আসায় কি সমস্ত বইপ্রেমীরই যাতায়াতে সুরাহা হয়েছে? তেমনটা অবশ্য মানতে নারাজ হুগলির কামারকুণ্ডুর বাসিন্দা অরিন্দম দাস। বাড়ি থেকে দু’চাকায় চড়ে বইমেলায় গিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘মেট্রোয় যাতায়াতকারীদের একটা অংশের জন্য এ বার সুবিধা হয়েছে। শহরতলির যাঁরা শিয়ালদহ থেকে বইমেলায় যাচ্ছেন, কেবলমাত্র তাঁদের জন্যই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুবিধা রয়েছে। কারণ, বইমেলায় যেতে হলে আগে শিয়ালদহ পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে মেট্রো ধরলে বইমেলায় পৌঁছনো যাচ্ছে।’’ তবে কসবা বা বেহালার মতো শহরের অন্য প্রান্তের মানুষজনকে বাসে চড়েই পৌঁছতে হচ্ছে বইমেলায়। যদিও বই উৎসবে এ হেন ‘সামান্য’ অসুবিধাকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি অধিকাংশ বইপ্রেমী। ফলে অতিমারি পর্বের বাধা কাটিয়ে স্বমহিমায় ফিরে এসেছে ভিড়ে ভিড়াক্কার পরিচিত বইমেলাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy