Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Women Traffick Racket

ফিরে আসার জেদে অপরাজিতা

সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের পথে ভ্যান চালিয়ে বাবার যৎসামান্য রোজগারে ছ’জনের দু’বেলা পেটটুকুও ভরে না রোজ। পড়াশোনা দূর অস্ত্‌! অথচ ঘরের পাশেই স্কুল।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

স্বাতী মল্লিক
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:০৫
Share: Save:

বিশালাকৃতি বোল্ডারের প্রায় খাড়াই গা বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছিল মেয়েটা। কোমরে দড়ি, হাতে জ়ুমার, পায়ে দামী জুতো ছাড়াই। জানতে পেরে রক ক্লাইম্বিং শিবিরে আসা বাকি প্রশিক্ষকেরাও ততক্ষণে সেখানে। ‘‘তুই তো স্পাইডারওম্যান রে! আবার ওঠ দেখি!’’

সে কথা উঠতেই ঝলমলে হাসি একুশের মুখে। ‘‘গ্রামের মেয়ে, ছোট থেকেই গাছে উঠতে পারি। রোজ খেতে পেতাম না, এর-ওর গাছে উঠে ফলমূল চুরি করতাম। তা-ই হয়তো...।’’

এ ভাবেই কি বাধার এভারেস্ট টপকানোর স্পর্ধা অর্জন করে ফেলেছিল সে? হবে হয়তো। না-হলে পাচার হয়েও কেনই বা ভাববে, ‘মরি মরব, তবু সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করব’! শৌচালয়ে ঢুকে ফোনে ফিসফিসিয়ে সিআইডি-কে বলবে— ‘‘আমাদের কালই নেপালে পাঠিয়ে দেবে বলছে। ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে প্রায় ২৫ জন আছি। আপনারা কি আজ রাতের মধ্যে আমাদের বাঁচাতে পারেন?’’

রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে মেয়েবেলার কথা বলতে গিয়ে খানিক আনমনা। তিন বোনের পরে এক ভাই। সে মেজো। মা ঘরেই থাকে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের পথে ভ্যান চালিয়ে বাবার যৎসামান্য রোজগারে ছ’জনের দু’বেলা পেটটুকুও ভরে না রোজ। পড়াশোনা দূর অস্ত্‌! অথচ ঘরের পাশেই স্কুল। ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়লেই মা বলত, ‘‘ওই যে স্যর পড়াচ্ছেন। তোরাও শুনে শুনে পড়।’’ আর দুগ্গাপুজো? চার চারটে ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামা কেনার পয়সা কই? তাই পুরনো, ছেঁড়াফাটা জামাতেই দিদির সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াত গাঁয়ের মাঠের পুজোয়। হতদরিদ্র বলে কেউ যে মিশতেও চায় না ছাই!

তবে জীবনের প্রথম সুযোগ এসেছিল পুজোতেই। নাচের ‘শো’ করার সুযোগ। অন্য গ্রাম থেকে নাচ শেখাতে এল স্যর। ‘শো’-এর শেষে দু’বোনের হাতে দিত দুশো, তিনশো টাকা করে। দূরের গ্রামে গেলে চার-পাঁচশো। সেই টাকা বাবার হাতে দিতে পেরে কত আনন্দ কিশোরীর! মা ভাবত, মেয়েরা রোজগার করছে, সেই টাকাতেই ওদের লেখাপড়া হবে।

‘‘বিহারে নাচতে যাবি? দিনে হাজার টাকা করে দেবে। বাড়িতে বলবি না কিন্তু! বলবি, কয়েক দিন সবাই মিলে ঘুরতে যাচ্ছিস’’— বলেছিল স্যর।

হা-জা-র টাকা! সে তো অনেক! দিদিকেও তাই আর বলা হয়নি সত্যিটা। অতএব, স্যরের হাত ধরে ঘুরতে যাওয়া জনা আটেকের নাচের দল পাচার হয়ে গেল বিহারে। বাসে বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছিল স্যর— ‘‘চেঁচামেচি করিসনি, লোকে শুনলে কী বলবে! কয়েক দিন পরেই তো ফিরে আসব।’’

হাতবদল হল বিহারের এক উঁচু পাঁচিলওয়ালা বাড়িতে। বেসমেন্টের যে ঘরে তিন অচেনা মেয়ের সঙ্গে ঠাঁই হল, সেখানে নাকি আগে একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল। ‘‘শুনে খুব কেঁদেছিলাম। আর ভেবেছিলাম, পালানোর চেষ্টা করবই। সক্কলকে বাঁচাতে হবে আমায়।’’— বলে চলে শান্তশিষ্ট মেয়েটা। খেতে দিত না প্রায়ই। তবে পথেঘাটে, বিয়েবাড়িতে নাচের শো তখনও চলত। লরির উপরে দাঁড়িয়ে নাচতে হত দুপুর থেকে রাত।

এক দিনআড়ি পেতে ওদের কথা শুনতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেল স্টিলের থালা। ‘‘আমাদের কথা শুনছিলি? এত্ত সাহস!’’ জুটল মার। সিগারেটের ছ্যাঁকা। ‘‘সে রাতেই মনে পড়ল, মা-বাবাকে লুকিয়ে দিদির কিনে দেওয়া ছোট্ট মোবাইলটার কথা। ওটা ব্যাগে আছে, তা এত দিন মনেই পড়েনি। আমার কাছে যে মোবাইল থাকে, এটা তো দিদি ছাড়া কেউ জানেই না। তাই ওরাও আমার ব্যাগ খুঁজে দেখেনি। মনে হল, ফোনটা দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি।’’

উদ্ধারের পরে কলকাতার হোমে এসেও সইতে হয়েছে অত্যাচার। আড়াই মাস পরে অবশেষে ফেরা মা-বাবার কাছে। গ্রামে তত দিনে রটে গিয়েছে, পাচার হয়ে ফিরেছে দু’বোন। ‘নষ্ট মেয়ে’ সব। গোটা গ্রামে ঢি ঢি। সক্কলে মিলে একঘরে করে দিল গোটা পরিবারকে। কল থেকে খাবার জলটুকুও নিতে দিত না। পুকুরের জল ফটকিরিদিয়ে খেতে হয়েছে। বাবার ভ্যান চালানো, ভাইয়ের স্কুল— সব বন্ধ। ‘‘পাচার তো করল ওরা, আমাদের কী দোষ ছিল? আমরা কি কিছু ভুল করেছিলাম?’’ চোখে জল উপচে আসে মেয়ের।

তবু হার মানেনি সে। রুখে দাঁড়িয়েছে, পুলিশে খবর দিয়েছে। থানা থেকে খবর পেয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে পাচারফেরৎ মেয়েদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আলোর পথ’। সেখানকার মেন্টর সন্দীপ ভৌমিক বলছেন, ‘‘প্রথম যখন ওর বাড়িতে যাই, মুখ তুলে কথা বলেনি। মানসিক ট্রমা, আতঙ্কে ভুগছিল। ভাবত, ওকে টার্গেট করে রেখেছে। দু’বছর ধরে ওর কাউন্সেলিং করেছি, আগলে রেখেছি আমরা। সেলাই, বিউটিশিয়ানের কাজ শিখিয়েছি। মেয়েদের মধ্যে পাচার-সচেতনতা বাড়াতে ওকেই সামনের সারিতে তুলে এনেছি।’’

এর মধ্যে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছেন জোর করে, তার পাচার-বৃত্তান্ত লুকিয়ে। একুশে তরুণী আজ কোনও এক গাঁয়ের বধূ। তবে চোরা আশঙ্কাও পিছু ছাড়েনি। কবে যে সব কথা খুলে বলতে পারবে স্বামীকে! দু’দিন আগেও বিহার থেকে লোকেরা বাড়িতে এসেছিল! এই নিয়ে বেশ কয়েক বার এল। বলেছে, দুই মেয়েকে ছেড়ে দিতে আর মামলা তুলে নিতে। অনেক টাকা দেবে।

তবে ভয় পায় না সে— ‘‘রোজ এটা জেনেই বেরোই, আজ আর বাড়ি ফিরতে না-ও পারি।’’ তাই আত্মরক্ষার্থে ক্যারাটে শিখতে চায়। পড়াশোনাটাও।

বাতাসে ভেসে আসে পুজোর গন্ধ। বিয়ের পরে প্রথম পুজো! হাট থেকে একখান শাড়ি কিনে দিয়েছে বর। সেটা পরেই গিয়ে দাঁড়াবে গাঁয়ের পুজোয়। মনে মনে চাইবে, ‘আর কেউ‌ যেন পাচার না হয়ে যায় ঠাকুর।’

কে সে?

সে-ই তো অপরাজিতা।

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Against Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy