বাড়িতে মজিদ মাস্টার। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
বেলা তখন পৌনে বারোটা। ঘরের মাঝ বরাবর পাতা চৌকিতে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমোচ্ছে শীর্ণকায় এক চেহারা। দু’হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে তোলা। বালিশের পাশে রাখা রয়েছে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা একটি বই এবং রবীন্দ্র রচনাবলী।
১০ বছর আগের লোকসভা নির্বাচনের দিনটির সঙ্গে মেলানো যায় না রবিবারের শেষ দফার ভোটের দিনটিকে। যেমন একদা শাসনের ‘শেষ কথা’ মজিদ আলি ওরফে মজিদ মাস্টারের সঙ্গে মেলানো কঠিন তক্তপোশে ঘুমোনো ব্যক্তিটিকে। তবু ঘুম থেকে উঠে ওই ব্যক্তিই দাবি করেন, “আমিই মজিদ মাস্টার। এখন আর ভোট করি না, ভোট দিইও না।”
লোকসভা নির্বাচনের সপ্তম দফায় রাজ্যের আরও পাঁচটি কেন্দ্রের মতো ভোট হচ্ছে বসিরহাটে। বসিরহাটেরই অন্তর্গত মজিদ মাস্টারের এলাকা শাসন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই সেখানে ধীরে ধীরে সিপিএমের রাশ আলগা হতে শুরু করে। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে শাসনে নুর আলি নামে এক তৃণমূলকর্মী খুন হন। ওই ঘটনাতেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে গ্রেফতার হন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মজিদ মাস্টার। সেই কথা মনে করিয়ে এ দিন মজিদ বলেন, “আমার দলই আমাকে জেলে ভরেছিল। তবু আমি অন্য কোথাও নাম লেখাইনি।” তাঁর দাবি, এই আপস করতে না পারার জন্যই ২০০৯ সাল থেকে তাঁকে ঘরছাড়া হয়ে থাকতে হচ্ছে। মাঝে কিছু দিন যেখানে ছিলেন, সেই আস্তানাও বদলে ফেলতে হয়েছে মাস তিনেক আগে। এখন তিনি ছেলে মনিরুল ইসলামের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে থাকেন। রাত ১০টায় ঘুমোতে যাওয়া, ভোর ৫টায় ঘুম থেকে ওঠা, তার পরে মিনিট চল্লিশের হাঁটাহাঁটি। দিনের বাকি সময়টা বই পড়ে কাটে সত্তরোর্ধ্ব মজিদের। নিজেই জানান, ২৫ বৈশাখ থেকে রবীন্দ্র রচনাবলী পড়া শুরু করেছেন। তবে বই পড়ার শখেও এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘাড়ের ব্যথা। বললেন, “একটানা তিরিশ মিনিটও পড়তে পারি না। খুব ব্যথা করে। তা ছাড়া বাড়ির জন্য চিন্তা তো আছেই।”
কথার মধ্যেই বেজে ওঠে মজিদ মাস্টারের ফোন। ফোন ধরে এক কালের দাপুটে নেতা বলেন, “আর কী হবে? আমার ভোট তুমিই দিয়ে দাও!” ফোন রেখে জানান, পুরনো এক সিপিএম কর্মী খোঁজ নিচ্ছিলেন। কিন্তু লাভ নেই, ২০১৪ সাল থেকেই আর ভোট দেন না মজিদ মাস্টার।
একই ভাবে ভোট দেয় না মজিদ মাস্টারের গোটা পরিবারই। শাসনের বাজার এলাকা পেরিয়ে মাস্টারের বাড়ি কোন দিকে, সে পথ দেখিয়ে দিতে গিয়ে প্রত্যেকেই বলছিলেন, “মাস্টারকে আর পাবেন না। উনি তো এখন ওখানে থাকেন না।’’ তবু সরু, তস্য সরু গলি পেরিয়ে বাগানঘেরা একতলা বাড়িটায় পৌঁছে দেখা যায়, দুপুর-রোদে কাজে ব্যস্ত মাস্টারের ছোট মেয়ে রাজিয়া খাতুন। ভোটের তাপ-উত্তাপ স্পর্শ করেনি মাস্টারের স্ত্রী আসফনুরি বেগমকে। ভোটের বাজারে স্বামীর খোঁজ হচ্ছে শুনে প্রবল আতঙ্কিত স্ত্রী বলেন, “আপনারা দয়া করে ভিতরে এসে বসুন। বাইরে অনেক সমস্যা।” লেবু-নুন-চিনির শরবত সহযোগে আলাপ যত এগোয়, ততই বাড়তে থাকে মাস্টারের বাড়ির সদস্যদের আশঙ্কা। আসফনুরি তার মধ্যেই জানিয়ে দেন, এ বারও তাঁরা ভোট দিতে যাননি। ফের হামলা হওয়ার ভয়ে। পাশে বসা রাজিয়া বলেন, “১৭ দিন আমরা বাড়িছাড়া ছিলাম। আমার বাবা তো চোর বা খুনি নন!” রাজিয়া দাবি করেন, তাঁর বাবা বাংলায় এমএ পাশ করেছেন। স্কুলে পড়াতেন। বাড়িছাড়া থাকাকালীন দূরশিক্ষায় ইংরেজিতেও এমএ করেছেন। “এমন লোক দোষী হতে পারে!”— বলেন রাজিয়া।
কথা শেষে ওঠার সময়ে বাইরের জ্যৈষ্ঠের তাপ আরও বেড়েছে। উত্তপ্ত ভোট-মরসুমে ঝামেলারও খবর আসতে শুরু করেছে বিক্ষিপ্ত ভাবে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মাস্টারের স্ত্রী বললেন, “এর বেশি এগোলে অনেকে দেখে ফেলবে। একঘরে হয়ে থাকা কাকে বলে আমরা দেখেছি। রামের খড়মের মতো মাস্টারমশাইয়ের খড়ম মাথায় নিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy