এ ভাবেই পড়ে রয়েছে কাটা ম্যানগ্রোভ। নিজস্ব চিত্র।
লাগাতার সরকারি প্রচারের পাশাপাশি বন দফতরের কড়া নজরদারি রয়েছে। কিন্তু সে সবের পরেও রক্ষা পাচ্ছে না সুন্দরবন। ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। কেটে ফেলা হচ্ছে বিঘের পর বিঘে জমির গাছ। শুধু তাই নয়, গাছ কাটার পর সেই জমিতে মাছের ভেড়ি এবং বেআইনি নির্মাণকাজ চলছে। কোথাও কোথাও দখল হওয়া জায়গা বেআইনি ভাবে চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসনের নাকের ডগায় এই কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন ওই ব্যবসায়ীরা। শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় জমি মাফিয়ারা অবাধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ। তৃণমূল যদিও এ সব অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তবে, বন দফতর কিন্তু এই গাছ কাটার বিষয়টি মেনে নিচ্ছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে বলেও তাদের দাবি।
সুন্দরবনের যে যে এলাকায় সবুজে কোপ পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম রায়দিঘি। অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরেই রায়দিঘির মণি এবং ঠাকুরান নদীর পাড় ও চরের জঙ্গল সাফ করে ফেলছে জমি মাফিয়ারা। বেশ কয়েক বার জঙ্গল কাটার প্রতিবাদ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু, তা করতে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি মিলেছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েও সুরাহা মেলা না। শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে জমি মাফিয়া ও দুষ্কৃতীরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ।
রায়দিঘির দমকল ফেরিঘাট থেকে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়বে মণি নদীর পাড়ে বিঘের পর বিঘে ফাঁকা জায়গা। এলাকাবাসীর দাবি, এখানেই ছিল ম্যানগ্রোভ অরণ্য। প্রায় ৪০ বিঘে জায়গা জুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে একের পর এক গাছ। সে জায়গাতেই জমি মাফিয়ারা নির্মাণকাজ শুরু করেছে। দখল হওয়া জায়গা চড়া দামে বিক্রিও হচ্ছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দা মৃত্যুঞ্জয় মিস্ত্রির কথায়, ‘‘চোখের সামনে এলাকার গাছগুলো কেটে সাফ করে দিচ্ছে। প্রতিবাদ, অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছে না। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টে আমাদেরই মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যারা গাছ কাটছে, তারা যে একটা অপরাধ করছে, সেই বোধটাই কারও নেই।’’
একই ছবি দমকলের ঠাকুরান নদীর মোহনায় মকবুলের ট্যাঁকেও। এখানে প্রায় ২২ বিঘা বাদাবন সাফ হয়ে গিয়েছে বলে এলাকাবাসীর দাবি। মাসখানেক আগেও একদল দুষ্কৃতী ওই জমি দখল করতে আসে বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দারাই তাদের আটকে দেন।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে পূর্ব শ্রীধরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভুবনেশ্বরী চরে। স্থানীয়দের দাবি, প্রায় দেড় হাজার বিঘে জায়গা জুড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য সাফ করে অবাধে তৈরি হয়েছে মেছোভেড়ি। অথচ কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, বন দফতরের আওতাধীন এই জায়গা খালি করে দিতে হবে। কিন্তু আদালতের নির্দেশকে অমান্য করেই প্রকাশ্যে ‘কারবার’ চলছে।
গাছ যে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে তা মেনে নিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভাগীয় বনাধিকারিক (ডিএফও) মিলন মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। বন দফতরের তরফে জেলার পুলিশ-প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৩ জনের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’
চোরাপথে জঙ্গলে কারবার চালায় অসাধু ব্যবসায়ীরা।
রায়দিঘির যে ক’টি জায়গায় অবাধে ম্যানগ্রোভ কাটা চলছে সেগুলি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ছোট ছোট এই বনগুলিতে বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া, গেঁয়ো, গরাণ, হেঁতাল, গর্জন ও সুন্দরী প্রজাতির ম্যানগ্রোভ রয়েছে। বাঘ না থাকলেও এ সব জায়গায় লুপ্তপ্রায় বাঘরোল, ভাম, শেয়াল-সহ বহু প্রাণীর বাসস্থান ছিল। ম্যানগ্রোভের ডালেই বাসা বাঁধত বক, কাস্তেচরা-সহ বহু পাখি। কিন্তু লাগাতার অরণ্য ধ্বংস করায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র ক্রমশ ভেঙে পড়েছে বলে মত পরিবেশবিদদের। সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের প্রাক্তন অধিকর্তা তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রণবেশ সান্যালের কথায়, ‘‘এ ভাবে ম্যানগ্রোভ কাটতে থাকলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র নষ্ট হয়ে যাবে। ম্যানগ্রোভের উপরে প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভরশীল জলজ প্রাণীরাও। গাছ নষ্ট হলে জল এবং স্থলের বাস্তুতন্ত্রও বিঘ্নিত হবে।’’
সুন্দরবন জুড়ে চলতে থাকা এই ‘কাজকর্ম’ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি সরব রাজনৈতিক দলগুলিও। জঙ্গল ও ম্যানগ্রোভ বাঁচিয়ে রাখতে আন্দোলনে নেমেছেন অনেকে। অধিকাংশই সরাসরি শাসকদল তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলছে। আন্দোলনকারীদের তরফে ইয়াসিন গাজি যেমন বলছেন, ‘‘আমরা প্রতিবাদ করচি। কিন্তু, শাসক দলের নেতাদের কারণেই জমি-মাফিয়ারা বার বার ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।’’
প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়েরও একই অভিযোগ। তিনি বলেন, ‘‘ম্যানগ্রোভ কেটে সুন্দরবন ফাঁকা করে দিচ্ছে মাফিয়ারা। প্রতিনিয়ত এদেরকে মদত দিয়ে চলেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী তৃণমূল নেতারা। প্রশাসনকে বহু বার জানিয়েছি। কিন্তু কেউই গুরুত্ব দিতে চাইছেন না।’’
আরও পড়ুন: সপ্তম পর্বের আনলকে নয়া করোনা নির্দেশিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের
আরও পড়ুন: গোটা বাংলায় দলের পর্যবেক্ষক তিনিই, নাম না করে কাকে বার্তা দিলেন মমতা
তবে প্রাক্তনের এই অভিযোগ নস্যাৎ করে তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করছেন বর্তমান সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা মন্টুরাম পাখিরা। তাঁর কথায়, ‘‘ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের সঙ্গে আমাদের দলের কোনও যোগ নেই। বিরোধীরা মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। বামফ্রন্ট আমলে প্রচুর ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু এখন বন দফতর কড়া নজর রেখেছে। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের খবর পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ও হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy