Advertisement
E-Paper

শিবাজির বিকল্প শশাঙ্ক, বাংলার নিজস্ব হিন্দুত্বের খোঁজে জয়ধ্বনি গৌড়াধিপতির নামে! নববর্ষের আগেই প্রথম পূর্ণাবয়ব মূর্তিও

জাতীয় স্তরের ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’কে ছেড়ে বাঙালি হিন্দুর নিজস্ব ‘হৃদয়সম্রাট’ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গে। নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের জয়ধ্বনিতে মনোনিবেশ বাংলার বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের।

In search of Bengal’s own Hindutva, BJP-RSS hails Shashanka leaving Shivaji behind, First full length statue of the Gauda King to be inaugurated before Bengali New Year

বাঙালির ‘নিজস্ব হিন্দুত্বে’র প্রতীক খুঁজে বার করতে শিবাজির বিকল্প হিসেবে তুলে আনা হচ্ছে শশাঙ্ককে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৫ ১০:১৪
Share
Save

কখনও তাঁর গগনচুম্বী মূর্তি স্থাপন। কখনও তাঁর বাহিনীর মূলমন্ত্রকে বর্তমান ভারতীয় নৌসেনার মূলমন্ত্র করে তোলা। কখনও আবার তাঁর নামের জয়ধ্বনিকে বিজেপির নির্বাচনী রণধ্বনি করে তোলা। তবে তিনি শ্রীরাম নন। বরং তিনি শ্রীরাম ব্যতীত একমাত্র রাজপুরুষ, যাঁকে বিজেপি গোটা দেশের সামনে ‘সুশাসনের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে। তিনি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ। কিন্তু সেই ‘অপ্রতিরোধ্য’ ঘোড়াটির লাগাম বঙ্গের সীমানায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ যেন টেনে ধরে। বার বার বর্গি হানার আখ্যান মনে করিয়ে দেওয়া হয়।

জাতীয় স্তরের ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’কে ছেড়ে তাই বাঙালি হিন্দুর নিজস্ব ‘হৃদয়সম্রাট’ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে পশ্চিবঙ্গে। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের জয়ধ্বনিতে মনোনিবেশ করেছে বাংলার বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার।

গত চার-পাঁচ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ-বিজেপির শশাঙ্ক-চর্চা বাড়ছে। বঙ্গাব্দের প্রবর্তক শশাঙ্ক ছিলেন না কি আকবর, তা নিয়ে তর্ক বহু দিনের। গত কয়েক বছরে সেই তর্কে বিজেপি-আরএসএসের সওয়াল আগের চেয়ে বেশি উচ্চকিত হয়েছে। শশাঙ্কের সিংহাসন আরোহণের বছর থেকেই সূর্যসিদ্ধান্ত মতে বাংলা সাল গোনা শুরু হয়েছে বলে বিভিন্ন মঞ্চ থেকে বিজেপি-আরএসএস দাবি করছে। ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শশাঙ্কের রাজত্বকাল ধরা হয়। বিজেপি-আরএসএস যোগবিয়োগ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, বঙ্গাব্দের প্রবর্তন শশাঙ্ক ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ১৪৩২ বঙ্গাব্দ আসন্ন। শশাঙ্কের সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়ে থাকলে ১৪৩২-এর সঙ্গে রাজ্যাভিষেকের বছর, অর্থাৎ ৫৯৩ যোগ করলে বর্তমান খ্রিস্টীয় সনে পৌঁছোনোর কথা। সংখ্যা দু’টির যোগফলও ২০২৫-ই দাঁড়াচ্ছে।

এই অঙ্ককে ‘হাতিয়ার’ করেই বিজেপি প্রশ্ন করছে, আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে যদি বঙ্গাব্দ গণনা শুরু করে থাকেন, তা হলে এ বছর ১৪৩২ বঙ্গাব্দ হয় কী ভাবে?

শশাঙ্ক-চর্চার আরও নানা উপকরণ গত কয়েক বছরে তৈরি করা হয়েছে। ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের কোনও মূর্তি বা ছবি কখনও মেলেনি। কিন্তু বঙ্গীয় হিন্দুত্ববাদীরা কয়েক বছর আগে থেকেই খড়্গধারী শশাঙ্কের কাল্পনিক ছবি তৈরি করে সমাজমাধ্যমে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। তাতে হিন্দুত্ব শিবিরের বিড়ম্বনা কিছুটা বেড়েছিল। কারণ, শশাঙ্কের নানা রকম ছবি বাজারে ঘুরতে শুরু করেছিল। সে বিড়ম্বনা কাটাতে সংগঠিত ভাবে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরএসএসের একটি সহযোগী সংগঠনের এক রাজ্য স্তরের পদাধিকারীর কথায়, ‘‘বছর চারেক আগে কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের এক ছাত্রকে দিয়ে আমরা একটা ছবি তৈরি করাই। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখায় শশাঙ্কের যে বিবরণ মেলে, তার ভিত্তিতেই ছবি আঁকানো হয়েছিল।’’ সেই ছবি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে সেটিকেই সমাজমাধ্যমে এবং আন্তর্জালে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার সম্মিলিত ভাবে শশাঙ্ক-ভজনা শুরু করলেও গোটা অভিযানকে সংগঠিত করার দায়িত্ব ছিল ‘সংস্কার ভারতী’র। আরএসএসের এই সাংস্কৃতিক শাখা গত কয়েক বছর ধরে প্রত্যেক বাংলা নববর্ষের আগে শশাঙ্কের ছবি সম্বলিত ক্যালেন্ডার প্রকাশ করছে। বছর দুয়েক আগে সেই মঞ্চেই অনুষ্ঠান চলার পাশাপাশি শশাঙ্কের আবক্ষ মূর্তির ‘লাইভ’ নির্মাণও হয়েছিল। এ বছরের নববর্ষ আবাহনে সেই ‘সংস্কার ভারতী’ই শশাঙ্কের প্রথম পূর্ণাবয়ব মূর্তিটি প্রকাশ্যে আনবে। সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাধারণ সম্পাদক তিলক সেনগুপ্তের কথায়, ‘‘আমরা শুধু ছবি বা মূর্তি বানাচ্ছি না। আমরা মহারাজ শশাঙ্কের নানা বীরগাথাও তুলে এনেছি। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বগুলির কাহিনি নিয়ে ক্যালেন্ডারের ১২টি পাতার জন্য ১২টি ছবি তৈরি করা হয়েছে।’’ আগামী ৮ এপ্রিল জাতীয় গ্রন্থাগারে ‘নববর্ষ আবাহন’ অনুষ্ঠানে সেই ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হবে। সেখানেই গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের প্রথম পূর্ণাবয়ব মূর্তিরও আবরণ উন্মোচন হবে।

বছর দুয়েক আগে নববর্ষ আবাহনের অনুষ্ঠানে শশাঙ্কের এই আবক্ষ মূর্তিরই ‘লাইভ’ নির্মাণ হয়েছিল।

বছর দুয়েক আগে নববর্ষ আবাহনের অনুষ্ঠানে শশাঙ্কের এই আবক্ষ মূর্তিরই ‘লাইভ’ নির্মাণ হয়েছিল। —নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু শিবাজির বিকল্প হিসেবে শশাঙ্কের ‘বিগ্রহ’ প্রতিষ্ঠার কথা কী ভাবে মাথায় এল? এর ব্যাখ্যা বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের কেউ প্রকাশ্যে দিতে রাজি নন। তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ এক লেখকের কথায়, ‘‘প্রথমত, গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ঘোষিত ভাবে শিব উপাসক ছিলেন। শিবাজিও তা-ই ছিলেন। দ্বিতীয়ত, শিবাজি যেমন মোঘল আধিপত্যের বিরুদ্ধে হিন্দু রাজা হিসেবে লড়েছিলেন, তেমনই শশাঙ্কও বৌদ্ধ আধিপত্যের মাঝে হিন্দু রাজা হিসেবে মাথা তুলেছিলেন। তৃতীয়ত, শশাঙ্কের পরে বাংলায় আর এমন কোনও উল্লেখযোগ্য রাজশক্তি মাথা তুলতে পারেনি, যারা একাধারে বাঙালি এবং হিন্দু ছিল। পাল সাম্রাজ্য ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। আর সেনরা ছিলেন দক্ষিণী। তাই বাঙালি হিন্দুর নিজস্ব ‘হৃদয়সম্রাট’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করতে হলে শশাঙ্কই আদর্শ চরিত্র।’’

শিবাজির জয়ধ্বনি বাংলায় ধাক্কা খাচ্ছে বলে বিজেপি অবশ্য স্বীকার করতে চাইছে না। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘শিবাজির কথা উঠলেই বামপন্থীরা বার বার ‘বর্গি এল দেশে’ ছড়াটা আওড়াতে থাকেন। বাস্তবে শিবাজির সঙ্গে ওই বর্গিহানার কোনও সম্পর্ক নেই।’’ শমীকের ব্যাখ্যা, ‘‘শিবাজি এবং সম্ভাজির মৃত্যুর পরে মরাঠা সেনাবাহিনীর কোন অংশ ভেঙে গিয়ে কোথায় কী লুটপাট চালিয়েছে, তার দায় শিবাজি-সম্ভাজির নয়।’’ তা হলে এত সংগঠিত ভাবে শশাঙ্ক-চর্চা বাড়ানোর প্রয়োজন হল কেন? শমীক বলছেন, ‘‘বাংলার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের বহমানতার সঙ্গে শশাঙ্কই সম্পৃক্ত। তাঁকে অস্বীকার করলে ইতিহাসের বিচ্যুতি ঘটবে। বামপন্থী ইতিহাসবিদদের সৌজন্যে আমাদের দেশে ইতিহাসের বিচ্যুতিটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই বিচ্যুতি সংশোধনের চেষ্টা হচ্ছে।’’ বিজেপি সাংসদের সংযোজন, ‘‘আমার বাড়িতে যে ঠাকুরের আসন, সেখানেও শিবাজি মহারাজের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত।’’

BJP Shivaji RSS West Bengal Politics Hindutva

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}