Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
চোরা-বালি
Illegal Sand Mining

জলাধারের গা ঘেঁষেই বালি তোলার অভিযোগ

প্রশাসনের নজরদারি সত্ত্বেও অবৈধ বালি ঘাটের ব্যবসা চলছে। ক্ষতি পরিবেশেরপ্রশাসনের নজরদারি সত্ত্বেও অবৈধ বালি ঘাটের ব্যবসা চলছে। ক্ষতি পরিবেশের

রানিগঞ্জের নারায়ণকুড়িতে মাঝ দামোদরে যন্ত্রের সাহায্যে অবৈধ ভাবে বালি তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ। সপ্তাহখানেক আগে ছবিটি তুলেছেন ওমপ্রকাশ সিংহ।

রানিগঞ্জের নারায়ণকুড়িতে মাঝ দামোদরে যন্ত্রের সাহায্যে অবৈধ ভাবে বালি তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ। সপ্তাহখানেক আগে ছবিটি তুলেছেন ওমপ্রকাশ সিংহ।

নীলোৎপল রায়চৌধুরী ও সুব্রত সীট
রানিগঞ্জ ও দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২০ ০৫:০৩
Share: Save:

রাত ৮টা। ভরা বর্ষায় ফুলে উঠেছে দামোদর। পাড়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, জলের মাঝে বেশ কয়েকটি আলো। ‘‘নৌকো নিয়ে সারা রাত বালি তোলা হচ্ছে’’— সম্বিৎ ফেরে পিছনে এসে দাঁড়ানো ছায়ামূর্তির কথায়। ‘‘বর্ষায় বালি তোলা?’’

‘‘কার ঘাড়ে ক’টা মাথা। জমি গিয়েছে এ জন্য...!’’, বলতে বলতে আঁধারে আড়াল নেয় ছায়া।

দৃশ্যপট পশ্চিম বর্ধমানের অণ্ডালের। পাণ্ডবেশ্বর, জামুড়িয়া, কাঁকসা-সহ নানা এলাকায়, অন্তত অজয় এবং দামোদর নদের পাড়ে বসত যাঁদের, তাঁদের একাংশের অভিজ্ঞতা একই। যদিও জেলাশাসক (পশ্চিম বর্ধমান) পূর্ণেন্দু মাজি বলেন, ‘‘জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মেনে এখন বালি তোলায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।’’

ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের হিসেবে, জেলায় মোট ২৪টি বৈধ বালিঘাট রয়েছে। ইসিএলেরও নিজস্ব বৈধ বালিঘাট আছে কিছু। সব ক’টি থেকেই নির্দেশিকা মেনে এখন বালি তোলা বন্ধ। কিন্তু ‘অবৈধ’ ঘাটের কানে সে নির্দেশিকা পৌঁছয় না-বলেই অভিযোগ বাসিন্দাদের।

বাসিন্দাদের একাংশ জানান, দামোদর-অজয়ে নৌকার সাহায্যে বালি তোলা হয়। নৌকায় তাকে জেনারেটর চালিত ‘সাব-মার্সিবল পাম্প’। পাম্পের দু’টি মুখে দু’টি পাইপ থাকে। একটি পাইপ বালি-সহ জল টানে নদ থেকে। অন্য পাইপটির সাহায্যে সেই জল-সহ বালি নদের পাড়ে ফেলা হয়। জল চুঁইয়ে নেমে যায়। পড়ে থাকে বালি। পরে তা ট্রাক্টরে করে তুলে অন্যত্র মজুত করা হয়। পাশাপাশি, তাঁদের অভিযোগ, ‘‘বৈধ ঘাট থেকেও অবৈধ ভাবে যন্ত্রের সাহায্যে বালি তোলা হচ্ছে।’’ যদিও বৈধ ঘাটের ইজারাদারেরা সে অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, কাঁকসায় অজয়ে বনকাটির শেওড়াতলা, পিয়ারাবাগান, দেউল, সাতকাহনিয়া, শ্মশানঘাট, বিদবিহারের শ্রীরামপুর এবং শিবপুরের পাশে অবৈধ বালি ঘাট রয়েছে। এমনও অভিযোগ উঠেছে, একটি বৈধ ঘাটের মালিকও অবৈধ ঘাট চালাচ্ছেন! দামোদর-অজয়ে অবৈধ বালিঘাট চলছে রানিগঞ্জের নূপুর, তিরাট, দামালিয়া, বল্লভপুর, অণ্ডালের মদনপুর, পাণ্ডবেশ্বরের কেন্দ্রা, জামুড়িয়ার ভুরিফরফরি-সহ কিছু এলাকায়।

কেন এই কারবার? উত্তর লুকিয়ে ‘সরবরাহ’ আর ‘বাজার’-এর মধ্যে। ‘লকডাউন’-পর্বে গোড়ার দিকে বন্ধ থাকলেও আনলক পর্বে মাস দেড়েক ধরে জেলার নির্মাণশিল্প ক্ষেত্রে ট্রাক, ট্রাক্টরে বালি সরবরাহ করা হচ্ছে। নির্মাণশিল্পের কারবারিরাই জানান, একশো সিএফটি (ঘনফুট) ‘অবৈধ’ বালি গুণমান অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে ১,৬০০ থেকে ২,২০০ টাকায়। বৈধ বালির দর একশো সিএফটি-তে পাঁচশো টাকা বেশি।

কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়িয়ে কী ভাবে সরবরাহ ‘হচ্ছে’ অবৈধ বালি? রানিগঞ্জের সিপিএম বিধায়ক রুনু দত্ত, সিপিএম নেতা পঙ্কজ রায়সরকার, বিজেপি-র জেলা সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোড়ুইয়ের অভিযোগ, ‘‘শাসক দলের নেতাদের মদত থাকায় প্রশাসন-পুলিশ কিছু দেখেও দেখে না।’’ আর তৃণমূলের জেলা সভাপতি জিতেন্দ্র তিওয়ারির সাফ কথা, ‘‘প্রশাসনের তৎপরতায় বালির অবৈধ কারবারই হয় না জেলায়। সেখানে আমাদের নেতা-কর্মীরা যুক্ত থাকবেন কী ভাবে? ভিত্তিহীন অভিযোগ।’’

রাজনৈতিক দোষারোপ তো চলতেই থাকে। আর তলে তলে জীবন-জীবিকার তলা থেকে বালি সরে যায়। কাঁকসার রামপ্রসাদ রায়, প্রসাদ দাস-সহ বাসিন্দাদের একাংশ বলেন, ‘‘বালির অবৈধ কারবারের জন্য কৃষিজমি তলিয়ে যাচ্ছে জলে। পথ-ঘাট ভাঙছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে।’’ রানিগঞ্জের নূপুরের মলয়কান্তি মণ্ডল, মিলন মণ্ডলদের ক্ষোভ, ‘‘নূপুর গ্রামের পাশে দামোদরে ৬০ ফুট উঁচু মাটির বাঁধ বানানো হয়েছিল। সে বাঁধও কেটে দিয়ে বালির ট্রাক, ডাম্পার নিয়ে যাচ্ছে বালি মাফিয়া।’’

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের কোলফিল্ড এরিয়া ডিভিশন ১-এর এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার চম্পক ভট্টাচার্যেরও অভিযোগ, ‘‘কিছু জায়গায় জলাধারের গা ঘেঁষে বালি কাটা হচ্ছে। ফলে, জলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। সব থেকে খারাপ হাল বারাবনির রুনাকুড়া, রানিগঞ্জের দামালিয়া ও হিরাপুরের সূর্যনগর জলপ্রকল্পের। প্রশাসনের নির্দিষ্ট জায়গায় বিষয়টি জানানো হয়েছে।’’ প্রসঙ্গত, ২০১৮-র নভেম্বরে ঝাড়গ্রামের এক সভা থেকে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, বেআইনি বালি খাদানের জেরে ‘ব্রিজের ক্ষতি হচ্ছে’।

তবে জেলাশাসকের আশ্বাস, ‘‘কোথাও অবৈধ ভাবে বালি তোলার চেষ্টা করা হলে প্রশাসন অভিযান চালায়।’’

পুলিশ কমিশনার সুকেশকুমার জৈনেরও আশ্বাস, ‘‘খবর পেলেই অভিযান হয়।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Illegal Sand Mining Paschim Bardhaman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy