ঈদের বাজারে সাত্তোরের নির্যাতিতাকে শাড়ি কিনে দিচ্ছেন বিজেপি নেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার কলকাতায় বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি
বিধানসভা নির্বাচনের ঢাকে এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে কাঠি পড়েনি ঠিকই। কিন্তু আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগে এ বারই শেষ রমজানের মরসুম। সেই আবহেই বাংলায় সরগরম হয়ে উঠেছে ইফতার রাজনীতি! কোন ইফতারে কে যাচ্ছেন, তা দিয়েও নেতাদের অবস্থান মাপা হচ্ছে রাজ্য রাজনীতিতে! ঠিক যেমন মঙ্গলবার বঙ্গ রাজনীতিতে চর্চায় থাকল ইফতারের নানা সমীকরণ।
হজ হাউস কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেয়ে এ দিন সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাসে রাস্তার উপরেই ইফতার-আসর বসালেন সপার্ষদ আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। সেই আসরের অবসরেই নিজের দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক হয়ে উঠলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হাফিজ আলম সৈরানি! রেজ্জাকের আমন্ত্রণে রাস্তার ইফতারেই হাজির ছিলেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র। রেজ্জাকের পাশে বসে তিনি যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু-দরদ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, সেই সময়েই আবার বিধান ভবনে ইফতার চলছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর। যেখানে সোমেনবাবু তো বটেই, প্রদীপ ভট্টাচার্য, মানস ভুঁইয়া, আব্দুল মান্নান, মহম্মদ সোহরাবের মতো প্রবীণ কংগ্রেস নেতাদের কাউকে দেখা গেল না। এমনকী, ইফতারে আমন্ত্রণ না পেয়ে সেই আসর বসার আগেই দফতর ছেড়ে চলে গেলেন বিধান ভবনের কর্মীরা! আর এই ঘটনাপ্রবাহের মাঝে মুখ্যমন্ত্রী মমতা নবান্নে ডেকে বৈঠক করলেন ইউডিএফ নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর সঙ্গে। যিনি জানিয়ে দিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে তাঁর সঙ্গে ‘সামাজিক ভাবে’ কাজ করতে তাঁদের আপত্তি নেই।
হজ হাউসে ইফতার আয়োজনের জন্য টাকা জমা দিয়েছিল রেজ্জাকের নতুন দল ‘ভারতীয় ন্যায়বিচার পার্টি’। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলকে সেখানে অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া যায় না বলে বেঁকে বসেছিলেন হজ হাউস কর্তৃপক্ষ। পূর্বঘোষণা মতোই এ দিন রেজ্জাক তাঁর দলবল নিয়ে দিলখুশা স্ট্রিটে ইফতারে বসে পড়েন। রাস্তাতেই চলে প্রার্থনা। রাস্তার ধারে হজ হাউস তখন তালাবন্ধ। কনক দেবনাথ, আমজাদ আলিদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে আসেন সোমেনবাবু। মুখ্যমন্ত্রীর নাম না করেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে সরকার সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে এত কথা বলে, তারাই সাধারণ সংখ্যালঘুদের ইফতারের জন্য মাথার উপরে ছাদ কেড়ে নিয়েছে! তাদের রাস্তায় বসিয়েছে! এতেই বোঝা যাচ্ছে, রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু-দরদ শুধু ভোটের জন্য।’’
রেজ্জাকের এই ইফতারের অবসরেই ফ ব নেতা হাফিজ আর এক ইফতার-বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন! ফ ব-র প্রবীণ রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা-বন্দনা এবং ইফতারে তৃণমূলের বিতর্কিত সাংসদ আহমেদ হাসান (ইমরান)-কে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে প্রবল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই হাফিজ এ দিন বলেন, ‘‘দু’টো সিদ্ধান্তই ভুল হয়েছে! এতে অশোকদা’র সম্মান নষ্ট হয়েছে, আমাদের দলের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ। নানা ব্যঙ্গ, টিকা-টিপ্পনীও শুনতে হচ্ছে!’’ এর জন্য দায়ী কে? হাফিজ বলেন, ‘‘অশোকদা’র কাছাকাছি থেকে যাঁরা কাজকর্ম পরিচালনা করেন, সেই আমরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছি না বলেই এমন হচ্ছে।’’
সোমেনবাবুরা কেউ বিধান ভবনমুখো না হলেও রাস্তার আসর শেষ করেই রেজ্জাক আবার ছোটেন অধীরের ইফতারে। একে সৌজন্য বলে বর্ণনা করেও বর্ষীয়ান বিধায়ক রেজ্জাক বলেন, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে আমরা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জোট চাই। এক দিকে বিজেপি-কে বাদ রেখে বাম, কংগ্রেস এবং আরও কিছু শক্তি এক সঙ্গে লড়লে তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দেওয়া যাবে।’’ রেজ্জাক যেখানে গিয়ে এই কথা বলেছেন, সেই বিধান ভবনের ছবি অবশ্য খুব সুখকর ছিল না! আমন্ত্রিত হয়ে বিধান ভবনে এসেও দলের দুই বর্ষীয়ান সাধারণ সম্পাদক মায়া ঘোষ এবং শুভ্রা ঘোষ ‘অপমানিত’ বোধ করেন। প্রদেশ সভাপতির কাছাকাছি না বসিয়ে অপরিচিতদের সঙ্গে বসার ব্যবস্থা হয়েছিল বলে তাঁদের অভিযোগ। দুই নেত্রী বাইরে অপেক্ষা করে ইফতার শুরু হতেই বেরিয়ে যান। সংখ্যালঘু শাখার চেয়ারম্যান খালেদ এবাদুল্লা (যিনি মানস-ঘনিষ্ঠ) এবং সোমেনবাবুর সহচর বাদল ভট্টাচার্য অবশ্য ইফতারে ছিলেন। ছিলেন ১২ বিধায়কও।
কংগ্রেসের দুই নেত্রীর মতো ‘অপমানিত’ বোধ করেছেন দলের রাজ্য দফতরের ১৯ জন কর্মীও। বেতন না পাওয়ার ক্ষোভে কর্মীরা গত সপ্তাহেই বিধান ভবনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। তাঁরাই এ দিন সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ দফতরের ছুটি হতেই একসঙ্গে বাড়ির পথে রওনা দেন। দফতরের বাইরে কয়েক জন কর্মী বলেন, ‘‘এ বাড়ির কর্মী বলে কী নিমন্ত্রণ না পেয়েও অনাহূতের মতো ভোজে যোগ দেব? কেউ তো আমাদের থাকার জন্য বলেনি!’’
অধীর অবশ্য এ সবে বিচলিত নন! তাঁর বক্তব্য, ‘‘দলের এত কর্মী এসেছেন। কর্মীরাই সব চেয়ে বড় নেতা। কোনও নেতার অভাব রয়েছে এখানে?’’ গলায় গামছা বেঁধে কাউকে যে ডেকে আনতে পারবেন না, তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy