প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই দুর্নীতি রোধে ব্যবস্থা নিতে গিয়েই রাজ্যের বর্ষীয়ান আমলা নন্দিনী চক্রবর্তীকে সরতে হল বলে অভিযোগ উঠেছে। নবান্ন সূত্রের খবর, সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরার নানা দুর্নীতিমূলক কাজকর্ম আটকাতে ব্যবস্থা নিতে গিয়েছিলেন ওই আইএএস অফিসার। তাতেই তাঁর উপর চটে যান মন্টুরাম। অভিযোগ জানান খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে। যার জেরেই শেষমেশ সরতে হল নন্দিনীকে।
এর আগে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ২০১২ সালের শেষের দিকে মন্ত্রী শ্যামল মণ্ডলকে সরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। দায়িত্ব পান দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরা। কিন্তু দু’বছরের মধ্যে তাঁর কাজকর্ম ঘিরেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। সুন্দরবন উন্নয়ন দফতর নিয়মিত তিনটি কাজ করে। খাঁড়ি-ঘেরা সুন্দরবন এলাকায় বাঁধ ও রাস্তা তৈরি, মিষ্টি জলের নলকূপ বসানো ও পুকুর কাটা এবং ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো। এর মধ্যে ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তরফেই নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে। ওই দুর্নীতি বন্ধেই নন্দিনী জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস বা উপগ্রহের মাধ্যমে ধরা চিত্র)-এর মাধ্যমে গাছ লাগানোর উপরে নজরদারির নির্দেশ দেন। দফতর সূত্রের খবর, সচিবের এই নির্দেশেই চটে যান মন্ত্রী। তিনি জানিয়ে দেন, এ ভাবে কখনওই গাছ লাগানোর উপরে নজরদারি সম্ভব নয়। কারণ, জিআইএস ইমেজে সব ধরা পড়ে না। যদিও সচিবকে সমর্থন করেন শাসক দলেরই স্থানীয় বিধায়ক তথা সুন্দরবন বোর্ডের সদস্য বঙ্কিম হাজরা, সমীর জানারা।
এর সঙ্গেই সুন্দরবন এলাকার চাষিদের জন্য সরঞ্জাম কেনা নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ বাধে সচিবের। গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে গুণগত মান খারাপ হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকেই সরঞ্জাম কেনার নির্দেশ দেন মন্টুরাম। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে সরকারি অধিগৃহীত সংস্থা থেকেই মিনিকিট, কী়টনাশক, ধানঝাড়া মেশিন, কীটনাশক ছড়ানোর যন্ত্র, মাছের চারা, জাল ইত্যাদি কেনার ব্যবস্থা করেন সচিব। এ বার ১২ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে দেন তিনি। রাজ্য সরকারের অধিগৃহীত সংস্থা রাজ্য বীজ নিগম এবং স্টেট ট্রেডিং কর্পোরেশনের কাছ থেকেই উন্নত মানের সরঞ্জাম কেনার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও মন্ত্রী চেয়েছিলেন বাম জমানা থেকেই দফতরে নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন কিছু ঠিকাদার ওই বরাত পান। অভিযোগ, চিনা মাল সরবরাহ করে এমন কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে সরঞ্জাম কেনার জন্যও চাপ আসতে থাকে সচিবের উপর। কিন্তু সচিব তা করতে চাননি। উল্টে তিনি রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের পুরো বিষয়টি আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। তাতে চটে যান মন্ত্রী। তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন, এই সচিবের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। সচিব তাঁকে কাজে বাধা দিচ্ছেন। নবান্ন সূত্রের খবর, মন্টুরামের অভিযোগ পাওয়ার পরেই নন্দিনীকে সচিব পদ থেকে বদলির নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।
যদিও মন্টুরামের দাবি, ‘‘এটা রুটিন বদলি। আমার সঙ্গে সচিবের কোনও গোলমাল নেই। আমি কারও নামে অভিযোগও করিনি।’’ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে মন্টুরামের বক্তব্য, ‘‘একেবারে মিথ্যা অভিযোগ। আমি কেমন লোক তা সবাই জানে। সরকারি নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার কোনও নির্দেশ আমি কোনও দিন দিইনি।’’ আর নন্দিনীদেবী বলেন, ‘‘আজই (বুধবার) দফতরের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।’’ নন্দিনীকে পাঠানো হচ্ছে প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের কমিশনার করে। তাঁর জায়গায় সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের কমিশনার হচ্ছেন এম ভি রাও।
নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনীকে পরিসংখ্যান দফতরের মতো আরও গুরুত্বহীন জায়গায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যের শীর্ষ কর্তাদের একাংশ এই প্রস্তাবে বেঁকে বসেন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, ‘‘দফতরের চুরি আটকাতে গিয়ে কোনও অফিসারকে শাস্তি পেতে হবে, এটা হতে দেওয়া যায় না।’’
নন্দিনীর মতো প্রবীণ এবং যোগ্য অফিসারকে অত গুরুত্বহীন দফতরে পাঠানোর ব্যাপারেও আপত্তি তোলেন তাঁরা। তবে প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের কমিশনারের পদে পাঠিয়েও নন্দিনীকে কার্যত কোণঠাসা করা হল বলেই মনে করছেন নবান্নের কর্তাদের একাংশ। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘ওই পদ অনেকটাই আলঙ্কারিক। প্রশাসনিক কাজকর্মে তাঁর তেমন গুরুত্বই নেই।’’ যদিও প্রশাসনের অন্য একটি অংশের মতে, কমিশনারের বেশ কিছু স্বাধীন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। এ ছাড়া, সামনের বিধানসভা ভোটে নির্বাচন কমিশন তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিতে পারেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রীর রোষে পড়ে গুরুত্বহীন পদে বদলি হওয়া অবশ্য নন্দিনীর ক্ষেত্রে এই প্রথম নয়। ২০১২ সালে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর এবং রাজ্য শিল্প উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্টেট গেজেটিয়ারের সম্পাদক পদে। সে বার বারাসতে যাত্রা উৎসব চলাকালীন নন্দিনীর কাছে খবর আসে, তাঁর
মেয়ে অসুস্থ। তিনি উৎসব মঞ্চেই মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, পরের দিন পানাগড়ের মাটি উৎসবে যেতে পারবেন না। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তাঁকে যেতেই হবে।
কিন্তু মেয়ের শরীর আরও খারাপ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মাটি উৎসবে আর যেতে পারেননি নন্দিনী। এর পরেই চটে গিয়ে তাঁকে গুরুত্বহীন স্টেট গেজেটিয়ার দফতরে পাঠানো হয়। আট-ন’মাস বাদে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরে মন্টুরাম পাখিরাকে নিয়ে আসার পরে নন্দিনীকেও ওই দফতরের সচিব পদে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু গত দু’বছরে বার তিনেক কেন্দ্রীয় সরকারি পদে যেতে চেয়ে আবেদন করায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর উপরে রুষ্ট ছিলেন বলে নবান্ন সূত্রে খবর।
মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা বেআইনি কার্যকলাপের অভিযোগ এবং তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে গিয়ে বদলি হওয়ার উদাহরণ গত চার বছরে কম নয়।
এর আগে প্রাক্তন উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বিরুদ্ধে উদ্বাস্তুদের জন্য নির্দিষ্ট জমি বেআইনি ভাবে বণ্টনের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল। তা আটকাতে গিয়ে সরকারের রোষের মুখে পড়েন দফতরের সচিব রীনা বেঙ্কটরমন। তাঁকেও একটি রেঞ্জের কমিশনার পদে বদলি করে দেওয়া হয়।
দমকল দফতরে হোমগার্ড নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি আটকাতে গিয়ে সরকারের রোষের মুখে পড়েন সচিব নীহার বন্দ্যোপাধ্যায়।
একই ভাবে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে সচিব সৈয়দ আহমেদ বাবা, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে মন কষাকষির জন্য চঞ্চলমল বাচোয়াতের মতো অফিসারদের সরিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্যের এক শীর্য কর্তার মন্তব্য, ‘‘উত্তরপ্রদেশের দুর্গাশক্তি নাগপাল বা হরিয়ানার অশোক খেমকার মতো আইএএস অফিসাররা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে বার বার বদলি হয়েছেন। কিন্তু এ রাজ্যে এমন ঘটনা তেমন একটা শোনা যেত না। নন্দিনীর ঘটনায় যেন তারই ছায়া দেখা যাচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy