শনিবার বিকেলে সাব ইনস্পেক্টর গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সেই ঘটনার কথা সোমবার বিকেল পর্যন্ত তাঁকে কেউ জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
শনিবার যেখানে যে সব গোলমালের খবর পেয়েছেন, সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক এবং পুলিশকে সেখানে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? সোমবারেও তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়।
বিভিন্ন বুথে পুনর্নির্বাচন চেয়ে বিরোধীরা সরব হয়েছেন। কিন্তু সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট সোমবার সন্ধে পর্যন্ত রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে পাননি তিনি।
তিনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।
পদটি সাংবিধানিক হলেও পদের মালিকের যে কার্যত কোনও ক্ষমতা নেই, সোমবার সেটা ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিলেন তিনি। গত শনিবার কলকাতা পুরসভার ভোটে বিপুল ব্যর্থতার পরে আগামী শনিবার রাজ্যের বাকি ৯১টি পুরসভার ভোট নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিলেন তিনি। আগাম আশঙ্কা জানিয়ে বললেন, প্রতিটি জেলার চরিত্র, বিশেষ করে অপরাধের ধরন আলাদা। উত্তর ২৪ পরগনার মতো জেলায় একই দিনে ২৩ পুরসভার নির্বাচন। আরও কঠিন।’’
এ যাবৎ নির্বাচনের দিন ঘোষণা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন— কোনও ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকার সুশান্তের কথা মানেনি। স্বরাষ্ট্রসচিব, জেলাশাসক, পুলিশ কর্তাদের নিয়ে সুশান্ত একের পর এক বৈঠক করেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রায় কেউই তাঁর কথায় আমল দেননি। সুশান্ত নিজেই কবুল করছেন, তিনি ক্ষমতাহীন। তাঁর কথায়, ‘‘যত ক্ষণ পর্যন্ত ভোটের দিন ঠিক করার ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া না হবে তত ক্ষণ এই ভাবেই কমিশন চলবে। নির্বাচনের কাজে যুক্ত সব সরকারি কর্মীকে কমিশনের নিয়ন্ত্রণে কাজ করানো না গেলে ওই সব কর্মী কমিশনের নির্দেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহা দেখাবেন। তাঁদের শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিতে হবে কমিশনকে।’’
ক্ষমতার এই সীমাবদ্ধতা রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পক্ষে যে বড় বাধা, তা মানছেন কমিশনের অন্য কর্তারাও। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের পর্যবেক্ষণ, সুশান্তর পূর্বসূরি মীরা পাণ্ডেও কিন্তু এই সীমিত ক্ষমতা নিয়েই কাজ করতেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা ও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে আইনি লড়াই লড়েছিলেন। জিতে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু সুশান্তবাবু রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও সংঘাতেই যেতে চাননি। কার্যত তিনি ‘আত্মসমর্পণ’ করেছেন বলে মীরা পাণ্ডের সঙ্গে কাজ করা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের একাধিক অফিসার-কর্মী মন্তব্য করেছেন। বিরোধীরাও তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইঞার মন্তব্য, ‘‘সংবিধানের ২৪১-কে ধারা কমিশনকে যে মর্যাদা দিয়েছে, সুশান্তবাবু তার অমর্যাদা করেছেন। ফলে তাঁর ওই পদে থাকা মানায় না।’’ আর বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যর মন্তব্য, ‘‘কোথায় নির্বাচন কমিশন? ভদ্রলোক তো নবান্নের বিশেষ প্রতিনিধির মতো কাজ করছেন।’’
সুশান্তবাবুর নিজের যদিও দাবি, মূল সমস্যাটা কমিশনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নিহিত। তাঁর বক্তব্য, জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মতো রাজ্য নির্বাচন কমিশনও যদি ভোটপর্বের সময় ভোটের কাজে নিযুক্ত ‘অবাধ্য’ কর্মীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা পায় তা বলে পরিস্থিতিটা আমূল বদলে যাবে। তা হলে সেই অধিকার স্থাপন করার চেষ্টা কেন তিনি করছেন না? পূর্বসূরির মতো আদালতের দ্বারস্থ কেন হচ্ছেন না? সুশান্তবাবুর জবাব, ‘‘এই সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র রাজ্য বিধানসভার। আমি এর মধ্যে ঢুকব কেন?’’
কিন্তু এর মধ্যে দিয়েই মীরার সঙ্গে সুশান্তর তফাৎ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে কমিশনের কর্মীদের মত। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী সখেদে ‘কমিশন অকর্মণ্য’ বলে যে আক্ষেপ করছেন, মীরা থাকলে তা হতে দিতেন কি না, সেই জল্পনা চলছে। প্রশ্ন উঠছে, সুশান্ত ডব্লিউবিসিএস অফিসার বলেই কি তাঁকে আমল দিচ্ছেন না আইএএস এবং আইপিএস অফিসারেরা? তিনি আইএএস অফিসার হলে কি তাঁকে এমন অবজ্ঞা করতে পারত প্রশাসন? সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সিদ্ধান্ত আপনারা নিন।’’ আর
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পঞ্চায়েত ও পুর আইন মেনে চলাই উচিত। কেউ কেউ সে সবের বাইরে গিয়ে প্রচার পেতে চান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজ্যের কথা মতোই চলতে হয় কমিশনকে।’’
সুশান্তবাবু রাজ্যের কথা মতোই চলেছেন। শুধু তাঁর আক্ষেপ, প্রশাসন তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট সহযোগিতা করেনি।
কী রকম? ‘‘ভোটের দিন যে সব অভিযোগ পেয়েছি, যেখানে যেমন প্রয়োজন সেই মতো পর্যবেক্ষক, পুলিশকে বলা হয়েছে। সর্বত্র তাঁরা পৌঁছেছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে ঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বলতে পারছি না।’’ সুশান্তবাবু আরও বলেন, ‘‘শনিবারের নির্বাচনের দিন গিরিশ পার্কে পুলিশের গুলি খাওয়ার ঘটনার রিপোর্ট সোমবারেও আমি পাইনি। বাধ্য হয়েই এ দিন সন্ধ্যায় আমি কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিয়ে রিপোর্ট পাঠাতে বলেছি।’’
রিপোর্ট পাঠানো হয়নি কেন? কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের ডিস্ট্রিক্ট মিউনিসিপ্যাল অফিসার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক শান্তনু বসু বলেন, ‘‘ঘটনাটি কলকাতা পুলিশের এলাকায় ঘটে। কলকাতা পুলিশই দেখবে।’’ কলকাতা পুলিশের কর্তারা (পুলিশ কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার সদর) ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি।
সুশান্তবাবুর অনুযোগ, পুরভোটের আগে এবং ভোটের দিন বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের রিপোর্ট চেয়েও সময়মতো পাননি। ‘‘যে সব বুথে দলগুলি পুর্ননির্বাচন চেয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের কাছ থেকে সেই সব বুথের রিপোর্ট আসেনি। মঙ্গলবারের মধ্যে রিপোর্ট চেয়েছি।’’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা যা যা রিপোর্ট পেয়েছি তা পর্যালোচনা করে রিপোর্ট তৈরি করছি। মঙ্গলবার তা কমিশনে চলে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy