বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। রবিবার নবান্নে। ছবি: দেবাশিস রায়।
ছুটির দিনের নিস্তরঙ্গ বিকেল। হঠাৎই রাজ্যের প্রশাসনিক সদর দফতরে ঢুকলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং সেই যে ঢুকলেন, গভীর রাত পর্যন্ত আর বেরোনোর নাম নেই! আমলা থেকে পুলিশ, সক্কলে তটস্থ! মুখ্যমন্ত্রী নাকি নবান্নেই রাত্রিবাস করবেন! রাত জেগে নজর রাখবেন বন্যা পরিস্থিতি এবং জলাধার থেকে জল ছা়ড়ার উপরে। মুখ্যমন্ত্রী বলে রেখেছেন, ‘‘সারা রাত একসঙ্গে কাজ করব!’’
জলমগ্ন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিও মমতার কড়া নির্দেশ, রাতভর থাকতে হবে পুরসভার সদর দফতরে। ফলে দিদির সঙ্গে সদ্য লন্ডন-ফেরত মেয়রও ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছেন পুরসভার লাল বাড়িতে। সঙ্গে আছেন মেয়র পারিষদ এবং পুলিশের বড় কর্তারা। যদিও কলকাতায় এ দিন তেমন কিছু বৃষ্টি হয়নি, জলাধারের জলে প্লাবিত হওয়ারও ব্যাপার নেই। তবু দিদির নির্দেশে কোথায় কেমন পাম্প চালিয়ে জল নামানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, সে দিকে কড়া নজর রাখছেন কলকাতার প্রথম নাগরিক। নিকটাত্মীয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানেও যেতে পারেননি!
কিন্তু প্রশ্ন হল, বন্যা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে মুখ্যমন্ত্রীকে কেন রাত জাগতে হবে? নিজের প্রশাসনের উপরে কি তাঁর ভরসা নেই? প্রশাসনের অন্দরে এ নিয়ে ক্ষোভ সবটা চাপা থাকছে না। বিশেষত শনিবারই মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে এক বিডিও-কে সবার সামনে ‘চাবকে লাল করে দেব’ বলে ধমকেছেন, প্রশাসনের বড় অংশের কাছে বিষয়টি ভাল লাগেনি। শনিবার বন্যা পরিস্থিতি দেখতে মমতা গিয়েছিলেন হাওড়ার আমতা, উদয়নারায়ণপুর এবং হুগলির পুরশুড়ায়। উদয়নারায়ণপুরে সরকারি আধিকারিক এবং জনপ্রতিনিধিদের সামনেই এক বিডিও-র উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী ওই কথা বলেন! তাঁর কাছে খবর ছিল, ত্রাণের কাজ না করে ওই বিডিও নাকি বন্যা-কবলিত এলাকার ছবি তুলছিলেন! কিন্তু ত্রাণ তদারকিতে নেমে মুখ্যমন্ত্রী যদি এমন আচরণ করেন, তা হলে প্রশাসনের মনোবলই ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের অন্দরেই তাই কথা উঠছে যে, মুখ্যমন্ত্রী মুখে যতই এক সঙ্গে কাজ করার কথা বলুন, কার্যত তিনি দেখাতে চান যে, তিনি একাই কাজ করেন!
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
বিরোধীরাও অভিযোগ করছেন, এই দেখাতে চাওয়াটাই হল আসল ব্যাপার। নইলে একান্তই যদি জল নিকাশির কাজ কেমন চলছে বা জলাধার থেকে জল ছাড়ার খবর রাখতে চান, সেটা মমতা তো নিজের বাড়ি থেকেই করতে পারেন। আলাদা করে নবান্নে রাত্রিযাপনের প্রয়োজন কী? প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘জল ধরে রাখার সীমা দেখে জলাধার থেকে জল ছা়ড়া হবেই। মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বসে অনশন করলেও এটা আটকানো যাবে না! আর মেয়রই বা পুরসভায় বসে জল ছাড়া আটকাবেন কী ভাবে?’’ আর বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘এক ঘণ্টার কাজ উনি রাত জেগে করবেন বলছেন। যত এমন করবেন, তত প্রমাণ হয়ে যাবে ওঁর সরকারে অন্য মন্ত্রী থেকে প্রশাসনিক আধিকারিক— কাজ করার কেউ নেই!’’
অথচ পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে নৌকা চেপে পরিস্থিতি দেখে মমতার সরকারেরই পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় কিন্তু বলেছেন, ‘‘আগে রাজ্য সরকারকে না জানিয়েই জলাধার থেকে জল ছাড়ায় সমস্যা বাড়ত। এখন আমাদের সরকার বিভিন্ন জলাধার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখে। ফলে, জল ছাড়লেও আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’’ কিন্তু সরকার যদি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতই থাকে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর নবান্নে রাত্রিবাসের দরকার হচ্ছে কেন? দলীয় সূত্রের খবর, ভোটের আগের বছরে রাজ্যে বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী আসলে কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্যের কোনও মুখ্যমন্ত্রীই দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মহাকরণে গিয়ে রাত কাটাননি। বাম জমানায় মমতা যখন বিরোধী নেত্রী, তখন বন্যার সময়ে তাঁর মুখে ‘ম্যান মেড’ তত্ত্ব বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ঘোষণা করেছেন, ‘‘গত কয়েক বছরে ম্যানেজ করেছি। ম্যান মেড বন্যা হতে দিইনি!’’
কিন্তু এ বার? বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর টীপ্পনী, ‘‘উনিই (মমতা) বলুন, বন্যা এখন কী মেড!’’ মমতা নিজেও স্বীকার করছেন, প্রচুর বৃষ্টি ও ভরা কোটাল একসঙ্গে হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। ডিভিসি, তিলপাড়া, মশানজোড়, গালুডি থেকে অনেক জল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকী, এ রাজ্য থেকে আপাতত নিম্নচাপটি বিদায় নিলেও পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড, ওড়িশায় প্রচুর বৃষ্টি হতে পারে। মমতার কথায়, ‘‘সেটাই জ্বালার উপরে জ্বালা!’’ মুখ্যমন্ত্রী এ দিনই জানিয়েছেন, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া ও বীরভূম— এই পাঁচটি জেলা সব চেয়ে বেশি বিপন্ন। মোট ১২টি জেলার ২১০টি ব্লক বন্যা কবলিত। ক্ষতিগ্রস্ত ৪৭টি পুরসভা এবং ৯, ৬৯১টি গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত ৩৬ লক্ষেরও বেশি লোক, ৫৮ হাজার বাড়ি। সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষ ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন। ১২১টি নৌকো উদ্ধারকাজে নেমেছে। আরও নৌকো নামবে। দক্ষিণবঙ্গে পরিস্থিতির উপরে নজর রাখবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর আসন্ন উত্তরবঙ্গ সফরও আপাতত স্থগিত করে দিয়েছেন। আজ, সোমবার তাঁর যাওয়ার কথা উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা-অশোকনগরের বন্যা পরিস্থিতি দেখতে। যেখানে কয়েক দিন আগে ত্রাণ বিলি করতে গিয়ে শাসক দলের বাধায় ফিরে আসতে হয়েছিল বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘আমরা ২৪ ঘণ্টা নজর রাখছি। কারও কাছে কোনও খবর থাকলে ১০৭০ নম্বরে জানান।’’
মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া এই তথ্য তুলে ধরে শাসক দলের নেতারা বলছেন, সঙ্কটের সময়ে রাজ্যের মানুষের পাশে থাকার জন্যই তিনি বিলেত সফর কাটছাঁট করে ফিরে এসেছিলেন। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘বাংলার মানুষ দেখতে পাচ্ছেন, তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী বিপদের সময় তাঁদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। প্রয়োজনে রাত জাগছেন।’’ ভোটের আগের বছরে মানুষকে এই বার্তাটি দেওয়াই যে মুখ্যমন্ত্রীর লক্ষ্য, সেটা এই কথাতেই স্পষ্ট। ঠিক যে কারণে সরকার ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দলকে ত্রাণ নিয়ে গিয়ে ‘রাজনীতি না করা’র আর্জি জানিয়েছেন মমতা, সেই একই কারণে নবান্নে বসে নিজেই রাশ হাতে তুলে নিচ্ছেন তিনি। আর পরিস্থিতির চাপে যখন রাতই জাগছেন, কেন্দ্রকে কি সাহায্যের জন্য বলবেন? রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির খবর জানতে এ দিন রাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। মুখ্যমন্ত্রী পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘আমরাই তো সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। গরিবের সংসার। যা থাকবে ভাগ করে নেব!’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থানের নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। খরা বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট খাতে টাকা দেয়। ওই টাকা রাজ্যের প্রাপ্য। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্য একাই ত্রাতা সাজতে গিয়ে কেন্দ্রের টাকা নিতে চাইছে না। এর মধ্যেও ভোটের অঙ্কই রয়েছে বলে তাঁদের দাবি। কংগ্রেসের বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কথায়, ‘‘সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকদের গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে বন্যার কথা বলতে হবে। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার তো কিছু নেই!’’
বলছেন বটে। আসলে বিরোধীরাও জানেন, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাই আসলে এখানে প্রবল! ২০১৬-র আগে তাঁকে যে দেখাতেই হবে, ‘আমি তোমাদেরই লোক’! অতএব? প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের সরস মন্তব্য, ‘‘শতবর্ষ আগে জন্মানো এক নাট্যকারের সৃষ্টি আলোড়ন তুলেছিল বাংলায়। সে নাটকের নাম ছিল ‘নবান্ন’। বানভাসি বাংলার নবান্ন নতুন নাটক দেখাল রবিবার!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy