ছবি: দীপঙ্কর দে।
পুনারাবৃত্তি হল ইতিহাসের।
ভোটে বিরোধীশূন্য শাসক দল। সন্ত্রাসের অভিযোগ মুখে মুখে ফিরছে বিরোধীদের।
বাম আমল দেখিয়েছিল, কী ভাবে একের পর এক নির্বাচনে সিপিএম দুরমুশ করে দিয়েছে বিরোধীদের। এখন বামেরা অতীত। কিন্তু বদলায়নি ছবি। বদলে গিয়েছে স্রেফ শাসকের নাম। যার নাম তৃণমূল। আরামবাগ-তারকেশ্বর জুড়ে এখন শুধুই তাঁদের দাপাদাপি। ভোটের ফলে সেখানে বামেদের তো ঠাঁই নেই-ই। কল্কে পায়নি কংগ্রেস, বিজেপিও। হুগলির এই দুই পুরসভার রং এখন শুধুই সবুজ।
গোটা আরামবাগ মহকুমায় মনোনয়ন জমার আগে থেকেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছিল বাম-কংগ্রেস-বিজেপি। তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিস্থিত এমন দাঁড়ায় যে ১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৬টিতেই তৃণমূল ছাড়া আর কোনও দল প্রার্থী দিতে পারেনি বা দিলেও সন্ত্রাসের কারণে প্রত্যাহার করে নিতে হয়। এই অবস্থায় নির্বাচনের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৬টি আসনে জয়লাভ করে আগেই বোর্ড গঠন নিশ্চিত করে ফেলেছিল তৃণমূল। বাকি তিনটি ওয়ার্ডে বিরোধীদের প্রার্থী থাকলেও অভিযোগ সেখানেও সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে শাসকদল। যার ফল, ওই তিনটিও দখল করেছে তৃণমূল।
তবে এমন অভিজ্ঞতা আরামবাগের যে প্রথম নয়, তা জানিয়েছেন শহরবাসীই। নির্বাচনের দিনই পুরএলাকার মানুষ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। কারণ, বাম আমলের শেষ তিন দফায় প্রায় এমন ঘটনাই তাঁরা দেখেছেন। তবে তফাতও ছিল বইকী। বাম আমলে পুর নির্বাচনে দুপুর ১২টার পর বুথ দখল হওয়ার রেওয়াজও ছিল। কিন্তু এবার শাসকদল সেখানেও বামেদের হারিয়ে দিয়েছে। অভিযোগ, যে তিনটি (১, ৬ এবং ১৯ নম্বর) ওয়ার্ডে ভোট হচ্ছিল সেগুলির ১১টি বুথই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দখল করে নিয়েছিল তৃণমূলের বহিরাগতরা।
এদিন সম্পূর্ণ ফল ঘোষণার পরে শহরের এক প্রবীণকে বলতে শোনা গেল, ‘‘এ আর নতুন কী! আগে ছিল ওরা (পড়ুন সিপিএম) আর এখন এরা (পড়ুন তৃণমূল)। এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী।’’
১৯৮৬ সাল থেকে আরামবাগ পুরসভা বামেদের দখলে। তার আগে ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত জনতা দলের বোর্ড ছিল। সে সময় আরামবাগ পুরসভায় ছিল ১২টি ওয়ার্ড। জনতা পেয়েছিল ৯টি আসন, ৩টি বামফ্রন্ট। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্ট ৭টি আসন পেয়ে বোর্ড গঠন করে, বাকি ৫টি আসন পায় কংগ্রেস। তারপর ২০০০ সাল পর্যন্ত ডানপন্থী দলগুলি প্রার্থী দিলেও অধিকাংশ প্রার্থীপদই তুলে নিতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের অভিযোগের তির ছিল বামেদের দিকে। প্রচুর ঝড়-ঝাপটা সামলে যে ক’জন টিকতেন তাঁদের মধ্যে ২০০০ সালে তৃণমূলের হাসি সরকার ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে একবার কাউন্সিলার হয়েছিলেন। পরের দফায় ২০০৫ সালে নির্বাচন করারই প্রয়োজন হয়নি। কারণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৮টি ওয়ার্ডেই বামফ্রন্ট প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। সেসময় তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি দলগুলির অভিযোগ ছিল, বামফ্রন্ট সন্ত্রাস করে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে দেয়নি। বিরোধীশূন্য পুরসভা উপহার দেওয়ার অভিযোগ ছিল বামেদের বিরুদ্ধে। আজ যা তৃণমূলের যুক্তি, তখন সিপিএমেরও সেই যুক্তি ছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো বিরোধীদের কোনও সংগঠনই নেই। পরিস্থিতি এক। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগও একসুরে বাঁধা। কেবল বদলে গিয়েছে মুখ।
সিপিএমের আরামবাগ জোনাল সম্পাদক পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘এটা দখলের ভোট হল। তৃণমূল বহিরাগতদের এনে সন্ত্রাস করে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে দেয়নি। পুলিশ এবং প্রশাসন ওদের সহযোগিতা করেছে।’’
তৃণমূল কী বলছে? দলের বিধায়ক কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা বলেন, ‘‘সিপিএম-সহ বামদলগুলির কোনও সংগঠনই নেই। ওদের সঙ্গে জনগণও নেই। মানুষ তৃণমূলের উন্নয়নের ধারায় মুগ্ধ হয়ে ভোট দিয়েছেন।’’
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই আরামবাগে তৃণমূলের সংগঠন মজবুত হতে থাকে। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৬ লক্ষ ভোটের (৫,৯২,৫০২) ব্যবধানে জেতা অনিল বসুর আরামবাগ কেন্দ্রটির ব্যবধান কমে ২ লক্ষর (২,০১,৫৫৮) কিছু বেশি ভোটে জেতেন সিপিএমের শক্তিমোহন মালিক। ক্রমে রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের প্রভাব বাড়ে। ফলে ২০১০ সালের পুরনির্বাচনে তৃণমূল সবকটি আসনেই প্রার্থী দিতে সক্ষম হয় এবং ১৮ টির মধ্যে ৬টি ওয়ার্ডে (৩, ৪, ৫, ৯, ১৩, ১৫) জেতে তারা। হুগলি জেলায় একমাত্র আরামবাগ পুরসভাই বামফ্রন্ট ধরে রাখতে পেরেছিল।
তারকেশ্বর পুরসভার বয়স ৪০ বছর। প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রথম দিকে তৎকালীন কংগ্রেস বিধায়ক প্রয়াত কানাইলাল শেঠ চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৭ সালে বামেরা রাজ্যে ক্ষমতায় আসে। তখন এই পুরসভায় প্রশাসক বসে। এর পরে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে টানা জেতে বামেরা। এই সময়ে পুরবোর্ডে বিরোধীদের উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাস’ করে ভোটে জেতার অভিযোগ তুলতেন বিরোধীরা। ২০১০ সালে অবশ্য ছবিটা কিছুটা বদলায়। সে বার ১৫টির মধ্যে ১০টি আসনে জিতে পুরসভা দখল করে তৃণমূল। সিপিএম পাঁচটি আসনে জেতে। এ বার সেখানে বিরোধীদের চিহ্নই রইল না। বিরোধীরা বলছেন, শাসক দলের এই জয়ের নেপথ্যে মানুষের সমর্থন নেই। রয়েছে বিরামহীন সন্ত্রাস। আর তার জেরে ভোটের আগে ১৫টির মধ্যে ১০টিতেই জিতে যায় তৃণমূল। বাকি যে পাঁচটি ওয়ার্ডে ভোট হয়েছে, সেখানেও মাত্র এক জন করে বিরোধী ছিল।
ওই পাঁচটি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩ নম্বর ওয়ার্ড ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ, বিদায়ী উপ-পুরপ্রধান উত্তম কুণ্ডুর স্ত্রী তথা তারকেশ্বরের শহর মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী কুহেলি কুণ্ডু ওই ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী কাকলী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এ নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কুহেলি মাত্র ৫৪টি ভোট পেয়েই থেমে গিয়েছেন। ফলে খাতায়-কলমে মসৃণ ভাবে তৃণমূল সেখানে জিতে গিয়েছে।
বিরোধীরা অবশ্য শাসকদের একচ্ছত্র আধিপত্যকে ‘সন্ত্রাসের জয়’ হিসেবেই দেখছে। তারকেশ্বরের সিপিএম নেতা স্নেহাশিস রায় বলেন, “যে ভাবে তৃণমূল সন্ত্রাস করেছে, কহতব্য নয়। এ ভাবে জিতে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা উচিৎ কি না, ওরা ভেবে দেখুক।” তাঁর দাবি, “আমরা একটা মাত্র ওয়ার্ডে লড়তে পেরেছিলাম। সেখানে মাত্র দু’ঘণ্টা আমাদের এজেন্টরা বুথে বসতে পেরেছিলেন। তার পরেই ওঁদের বের করে দেওয়া হয়। তাতেও আমরা ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছি।” সন্ত্রাস নিয়ে এখন সিপিএমের সঙ্গে এক সুর বিজেপি, কংগ্রেসের। শাসক দল অবশ্য সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। বিদায়ী পুরপ্রধান, তৃণমূল নেতা স্বপন সামন্তের যুক্তি, “ওরা বোমাবাজি করে, বিরোধীদের রক্ত ঝরিয়ে ভোটে জিতত। এ বার এমন একটাও ঘটনা ওরা দেখাতে পারবে? সন্ত্রাস নয়, মানুষ আমাদের জিতিয়েছে।”
জয়ের নেপথ্যে সন্ত্রাস নিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ যাই-ই থাকুক, অঙ্কের বিচারে হুগলির দুই পুরসভা থেকেই নিশ্চিহ্ন বিরোধীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy