Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Rath Yatra

পদব্রজে মাসির বাড়িতে শিলা, সাক্ষী রইল রথ

মঙ্গলবার এমনই এক বদলে যাওয়া ‘রথযাত্রা’র সাক্ষী রইল ‘শ্রীপাট’ মাহেশ।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

প্রকাশ পাল
শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২০ ০২:৩০
Share: Save:

কাঠের জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা, পেঁচা থেকে হরেক কিসিমের পুতুল, ছোটদের রথের পসরা সাজিয়ে বিকিকিনি নেই। কড়কড়ে জিলিপি রসের কড়াইতে ডুবিয়ে দোকানির হাঁকডাক নেই। জলসত্র নেই। সন্ধ্যা ছ’টায় অনায়াসে পার হওয়া যাচ্ছে জিটি রোড। ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে ঘোষণা নেই। স্নানপিড়ি মাঠে নাগরদোলা বসেনি। ঘরকন্নার জিনিস নিয়ে ত্রিপলে ঢাকা অস্থায়ী দোকান বসেনি। একচুল নড়েনি রথ।

মঙ্গলবার এমনই এক বদলে যাওয়া ‘রথযাত্রা’র সাক্ষী রইল ‘শ্রীপাট’ মাহেশ। অগণিত মানুষের ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনিতে রথারোহনে মাসির বাড়ির (জগন্নাথের সখী পৌর্ণমসীর বাড়ি) পথে যাওয়া নয়, করোনা জুজুতে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে থেকে যেতে হল মন্দিরের চৌহদ্দিতেই। গর্ভগৃহ লাগোয়া ধ্যানঘরে নিয়মরক্ষার অস্থায়ী মাসির বাড়িতে তাঁদের ঠাঁই হল।

মাহেশের ৬২৪ বছরের পুরনো রথযাত্রা বহু ঘটনার সাক্ষী। কথিত আছে, জগন্নাথদেবের ভক্ত ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরীতে গিয়ে দেবতার দর্শন না পেয়ে মনকষ্টে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন। ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে এসে প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গায় ভাসমান একটি নিমকাঠ পান ধ্রুবানন্দ। তা দিয়ে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। মাহেশে তখন জনবসতি অল্প। চতুর্দিক ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা। ধ্রুবানন্দের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহই আজও পুজিত হচ্ছে। ইতিহাস বলছে, তখন জগন্নাথ মন্দির ছিল গঙ্গার ধারে। সেখান থেকে রথ যেত চাতরায় গুন্ডিচাবাটিতে (মাসির বাড়ি)। পরবর্তী কালে বল্লভপুর এবং তার পরে মাসির বাড়ি পর্যন্ত রথের যাত্রাপথ কমে আসে। কিন্তু রথের চাকা কোনও বার থেমে থাকেনি।

চৈতন্যদেব মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন। পুরীকে বলা হয় ‘নীলাচল’। চৈতন্যদেব মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ আখ্যা দেন। শ্রীরামকৃষ্ণও এসেছিলেন মাহেশের রথের মেলায়। এখানে রথের মেলায় বনফুল বিক্রি করতে এসে হারিয়ে গিয়েছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী। প্রবীণেরা বলেন, একটা সময় ঘরকন্নার জিনিস কিনতে গ্রামগঞ্জ থেকে বহু মানুষ আসতেন। সময়ের সরণিতে মেলার পরিধি অনেক ছোট হয়েছে। তবুও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ধরে রেখেছিল এখানকার রথযাত্রা এবং মেলা।

মাহেশের রথের বৃত্তান্ত

• বর্তমান রথটি ১৮৮৫ সালে চালু হয়।

• লোহার কাঠামোয় কাঠ দিয়ে তৈরি।

• ১২টি লোহার চাকা। প্রতিটির বেড় ১ ফুট।

• উচ্চতা ৫০ ফুট।

• ওজন ১২৫ টন।

• বিগ্রহ বসে চতুর্থ তলে।

• রথের সামনে থাকে তামার দু’টি ঘোড়া, কাঠের সারথি।

তথ্য সহায়তা: সুশান্ত সরকার

করোনাভাইরাসের ভয়ে তাতে ছেদ পড়ল। জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবাইত সৌমেন অধিকারী বলেন, ‘‘অন্য বার এই দিনে জগন্নাথ মন্দির, মাসির বাড়ির মন্দিরে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এ বার ভক্তদের সরিয়ে রেখেই উৎসব করতে হয়েছে।’’ মঙ্গলবার সকালে ঠাকুরকে খিচুড়ি, অন্নভোগ, শাক, আলুরদম, পোলাও, ছানার তরকারি, চাটনি, পায়েস, মালপোয়া এবং অন্যান্য মিষ্টান্ন ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।

বেলা পৌনে চারটে নাগাদ তিন দেবতার প্রতিভূ হিসেবে তিনটি নারায়ণ শিলা নিয়ে শোভাযাত্রা মাসির বাড়ির মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। একটি নারায়ণ শিলা হাতে স্থানীয় সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় শোভাযাত্রায় শামিল হন। শিলা নিয়ে রথ প্রদক্ষিণ করা হয়। রথে যে পথ যেতে বিকেল গড়িয়ে যায়, মাত্র পনেরো মিনিটেই সেই যাত্রা সম্পূর্ণ হয়। ঈশ্বরভক্ত কল্যাণ বলেন, ‘‘প্রভু কোন পথ দিয়ে যাবেন, তা প্রভুই ঠিক করেন। তাঁর দেখানো পথেই আমরা চলি। রোগের প্রকোপ থেকে মুক্ত করে প্রভু শান্তি দেবেন, সেই কামনা করি।’’

শ্রীরামপুরের বাসিন্দা অশীতিপর চিকিৎসক অসিত দত্ত স্থানীয় আঞ্চলিক ইতিহাসের চর্চা করেন। তিনি বলেন, ‘‘শুধু রথের রশিতে টান নয়, বাচ্চাদের ছোট ছোট রথ নিয়ে উচ্ছ্বাস, বিভিন্ন দলের হরিনাম সংকীর্তন, অসংখ্য মানুষের আনাগোনা মিলনমেলায় রূপ নেয়। এ বার এই ঐতিহ্যেও ছেদ পড়ল। খারাপ লাগছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী!’’

করোনার আবহে পূর্ব ঘোষণামতোই গুপ্তিপাড়াতেও রথের চাকা গড়ায়নি। কার্যত ভক্তশূন্য দেবালয়ে আচার-অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ ছিল ২৮০ বছর পেরনো এই রথযাত্রা। শ্রী শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মঠ ও এস্টেটের প্রশাসক গোবিন্দানন্দ পুরী জানান, সকালে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে ভোগ নিবেদন করা হয়। পরে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির থেকে তিন বিগ্রহকে লাগোয়া কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরে অস্থায়ী মাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বাঁশবেড়িয়ার সন্তান সঙ্ঘের রথে চড়েন রাধাকৃষ্ণ। ৮৫ বছর ধরে এই উৎসব চলছে। রথ কমিটির তরফে চপল শেঠ জানান, রথটি থাকে মাঠে। এ বার রথ রাস্তায় বেরোয়নি। তার পরিবর্তে নিয়মরক্ষার্থে সঙ্ঘের সদস্যরা রাধাকৃষ্ণকে রথে চড়িয়ে মাঠেই কয়েকটি টান দেন। এখানেও মেলা বসেনি।

চন্দননগরের ১৭০ বছরেও রথও এ বার পথে বেরোয়নি। ভিড় এড়াতে জগন্নাথ মন্দির চত্বরে বসেনি মেলা।

লোকারণ্যে ধুমধাম, রথ টানতে তরুণ-যুবকের দলের উৎসাহ, রশি ছোঁওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা— কত দৃশ্যই এ বার হারিয়ে গেল করোনা জুজুতে!

অন্য বিষয়গুলি:

Rath Yatra Festival Unlock 1.0
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy