প্রস্তুতি: শেষ মুহূর্তের সাজ। বুধবার। ছবি: দীপঙ্কর দে
প্রাচীনতা এবং ঐতিহ্যের দিক থেকে পুরীর রথযাত্রার পরেই মাহেশের স্থান। পুরীতে যাওয়ার পথে চৈতন্যদেব এখানে জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন। পুরীকে বলা হয় ‘নীলাচল’। চৈতন্যদেব মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ আখ্যা দেন। এখানে রথের মেলায় পা পড়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণেরও।
সময় বদলেছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মাহেশের রথযাত্রা আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শের শাহ নির্মিত গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রথ আর মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে দর্শন করতে সম্বৎসর মানুষ এখানে আসেন। আর রথের সময় ঢল নামে পূণ্যার্থীর। ঈশ্বরের লোকগাথা তাঁদের মুখে মুখে ফেরে।
মাহেশের রথযাত্রা এ বার ৬২৩ বছরে পড়ল। এর সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক জগন্নাথে-সাধকের নাম। জনশ্রুতি, ধ্রুবানন্দ ভক্ত পুরীতে গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করতে না পেরে মনকষ্টে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন। তার পরে স্বয়ং জগন্নাথের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে এসে গঙ্গার ধারে বসেছিলেন। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গায় ভাসতে থাকা একটি নিমকাঠ তুলে তা দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন ধ্রুবানন্দ। শুরু হয় রথযাত্রা। মন্দিরের বর্তমান সেবাইতদের দাবি, ছয় শতাধিক বছর আগে ধ্রুবানন্দের তৈরি নিমকাঠের সেই বিগ্রহই আজও পূজিত হচ্ছে।
রথযাত্রা যখন শুরু হয়, তখন আর পাঁচটা জায়গার মতো মাহেশও ছিল ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা। জনবসতি নিতান্তই অল্প। তবে রথযাত্রার সৌজন্যে অখ্যাত জনপদ দ্রুত বিখ্যাত হয়ে যায়। সেই সময় জগন্নাথ মন্দির ছিল গঙ্গার ধারে। সেখান থেকে চাতরার গুণ্ডিচাবাটী অর্থাৎ মাসির বাড়ি পর্যন্ত রথ টানা হত। পরবর্তীকালে যাত্রাপথ কমে হয় বল্লভপুর। তার পরে আরও কমে বর্তমানে মাসির বাড়ি পর্যন্ত রথ টান হয়। এখন মাটির রাস্তা নেই। রথ চলে পাকা সড়কে। দু’পাশে ঝোপঝাড়ের পরিবর্তে বাড়ি, দোকান, আবাসনের জঙ্গল।
রথের সময় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা লৌকিক দেবতা হয়ে ওঠেন। প্রথা অনুযায়ী স্নানযাত্রার দিন ২৮ ঘড়া জল আর দেড় মন দুধ দিয়ে তিন বিগ্রহকে স্নান করানো হয়। তাতে দেবতারা জ্বরে পড়েন। ভক্তকুলের বিশ্বাস, এই সময় বিগ্রহের শরীরে হাত দিলে উত্তাপ অনুভূত হয়। লেপ-কম্বল মুড়ি দিতে হয়। আরামবাগ, গোঘাট, ঘাটাল থেকে কবিরাজ ডাকা হয়। তাঁদের তৈরি পাচন খেয়ে ভগবান সুস্থ হন। শুশ্রূষা-পর্বে জন সাধারণের জন্য মন্দিরে প্রবেশাধিকার থাকে না। রথযাত্রার এক দিন আগে মন্দির খোলে। ওই দিন রাজা হিসেবে অভিষেক হয় জগন্নাথের। এই অনুষ্ঠান হল— ‘নব-কলেবর’। সে দিন থেকেই ফের ভক্তদের দর্শন দেন ওই তিন দেবতা। প্রিয় খাবার পরিবেশন করা হয় তাঁদের।
এর পরেই সোজারথের দিন রথে চাপিয়ে তিন বিগ্রহকে জগন্নাথের সখী পৌর্ণমাসির কুঞ্জে, অপভ্রংশে মাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজপথে জগন্নাথের রথ গড়িয়ে চলে ভক্তদের রশির টানে। বিউগল কাসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। টান থামে বন্দুকের গুলির শব্দে। সোজারথের ন’দিনের মাথায় হয় উল্টোরথ। পূণ্যার্জনের আশায় হাজারো মানুষের ভিড় উপেক্ষা করেই রথের রশি ছোঁয়ার জন্য আকুল হয়ে পড়েন বয়স্ক মানুষেরা। রথের মেলার চেহারা অবশ্য কালের নিয়মে বদলে গিয়েছে। মেলার পরিধি কমেছে অনেকটাই। শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, এক সময় গ্রামগঞ্জ থেকে বহু মানুষ রথের মেলায় কেনাকাটা করতে আসতেন। সেই সংখ্যা এখন নেহাতই অল্প। তবে পথের ধারে ছোট্ট উনুনের উপরে কড়াইতে পাঁপড়ভাজা, বাদামভাজা আর মুচমুচে জিলিপির স্বাদ নিতে ভোলেন না অনেকেই।
এই আবহেই বদলে যাওয়া জনপদে প্রাচীনত্বের আস্বাদ খুঁজে পান তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy