দিনের আলো নিভতেই দ্রুত বদলে যাচ্ছে উত্তরপাড়া।
রাস্তায় বাড়ছে মোটরবাইকের ভিড়। সওয়ারি যুবকের সংখ্যা দুই, তিন বা চার। দেখার কেউ নেই। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কোনও কোনও বাইকের আবার সাইলেন্সর পাইপ খোলা। বিকট আওয়াজ কানে তালা ধরাচ্ছে পথচারীদের। আরোহীদের ভ্রুক্ষেপ নেই।
গত কয়েক মাসে উত্তরপাড়ায় গঙ্গার ঘাটগুলি সাজানো হয়েছে। দোলতলা, সখেরবাজার-সহ প্রতিটি ঘাটই এখন ঝাঁ-চকচকে। কিন্তু উৎপাত সেখানেও কিছু কম নেই। রাত হলেই সেখানে ঠান্ডা পানীয়ের বোতলে ভরা মদ যুবকদের হাতে হাতে ঘোরে। বোতল শেষ হলেই শুরু হয় উল্লাসের নামে গালিগালাজ, নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি। সম্মান বাঁচাতে সরে যান বয়স্কেরা।
রাত নামলেই শহরের পাল্টে যাওয়ার এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। কিন্তু শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই পাল্টে যাওয়া শুধু ক্ষণিকের আনন্দের জন্য নয়। এর সঙ্গে অপরাধও মিশে যাচ্ছে। তাতেই বাড়ছে দুশ্চিন্তা। মাস ছয়েক আগে এ শহরের বিভিন্ন রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়। এতে যান নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করা সহজ হবে বলে দাবি করেছিল পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু বিধি বাম। এর পরেও উদ্দাম যুবকদের লাগামছাড়া আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
গত বছরের গোড়ার দিকে মাখলার ভাগাড় মোড় এলাকার বছর সতেরোর এক তরুণকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। ওই তরুণ তখন ঘুমিয়েছিল। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার দিন কয়েক আগে মাখলার বিড়লা মোড়ে অল্পবয়স্ক দু’দল ছেলের বচসা, মারামারি হয়। তার নেপথ্যে ছিল একটি দলের পরিচিত এক তরুণীকে অন্য দলের কটূক্তি করা। তার জেরেই শেষমেশ খুন।
ঘটনার কথা জানতে পেরে সেই সময়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন শহরের বহু অভিভাবকই। কিন্তু তার পরেও রাস্তার মধ্যে তরুণীদের কটূক্তি, যুবকদের মারামারি, গালিগালাজ— ছবিটা পাল্টায়নি। দিনকয়েক আগে নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এখনও শিউরে উঠছেন শহরের এক বিবাহিত তরুণী। তিনি বলেন, ‘‘আমি ভদ্রকালীতে পালতের পুকুর এলাকায় নিয়মিত হাঁটতে যাই। পুকুরের বাঁধানো পাড়ে নিয়মিত মদ্যপান চলে। একদিন মদ্যপেরা নিজেদের মধ্যে মারপিট করতে করতে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। আমি বারণ করতেই একটি সাইকেল রাস্তায় ফেলে আমার পথ আটকানো হল। সঙ্গে গালিগালাজ। আর ওখানে দাঁড়াতে সাহস পাইনি।’’
অনেকেরই অভিযোগ, শহরের বেশ কিছু ক্লাবে দিনের বেলা তালা ঝোলে। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই অন্য চেহারা নেয়। তালা খোলে। ভিড় বাড়ে। ক্লাবের সামনে মোটরবাইকের সংখ্যা বাড়ে। আসে প্লাস্টিকের গ্লাস। ঠান্ডা জলের বোতল। তার পরে বসে যায় মদের আসর। তার সঙ্গে চিৎকার, চেঁচামেচি, হই-হুল্লোড়। প্রতিবাদ করতে গেলে দেখতে হয় লাল চোখ। ভদ্রকালী, কোতরং, মধ্য ভদ্রকালী, কাঁঠালবাগান বাজার, রামসীতা ঘাট স্ট্রিট, নবীনকৃষ্ণবাবু রোড— উৎপাত কোথাও কম, কোথাও বেশি।
কী বলছে পুলিশ?
রাত হলে পুলিশের টহলদারি চলে, এটা ঘটনা। কিন্তু রাত নামলে শহরের বহু যুবক যে ভাবে নেশায় ডুবছে এবং তার জেরে যে নানা ধরনের অপরাধ ঘটছে তা মানছে পুলিশ। একই সঙ্গে স্বীকার করছে তাদের অসহায়তার কথাও। কিছুদিন আগে পালতের পুকুর এলাকায় যে মহিলা বিপদে পড়েছিলেন, তাঁর দাবি, সেই সময় পুলিশকে ঘটনার কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ নির্জন ওই জায়গাটি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েই দায় সেরেছিল। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘লোকসংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। বাড়ছে অপরাধ। কিন্তু সেই অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা বাড়েনি। তাই পুলিশ সব সময় সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। অল্পবয়স্কদের মধ্যে নেশার প্রবণতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্টাচ্ছে অপরাধের ধরনও। তবে পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।’’
শহরের প্রবীণেরা মনে করছেন, অপরাধ কমাতে শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। কমবয়সীদের হাতে এখন প্রচুর টাকা, দামি মোবাইল। তার ভুল ব্যবহার হচ্ছে। তার ফলেই অপরাধ বাড়ছে। এ সব পরিবারকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy