পঠনপাঠন: নৈশ স্কুলে চলছে ক্লাস। নিজস্ব চিত্র
মাঠটা অন্ধকার। তা থেকে কয়েক হাত তফাতে থাকা তিনতলা বাড়িটার একতলার কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে। মাঝেমধ্যে ঘরের দিকে চোখ রেখে বারান্দায় পায়চারি করছেন কয়েক জন। সামান্য ফাঁক করা লোহার মূল গেটটা ঠেলে ঢুকতেই কানে এল, ‘‘মনেরে আজ কহ যে...’’।
সমস্বরে উচ্চারিত রবিঠাকুরের কবিতার লাইন শুনে মালুম হল, নিস্তব্ধ সেই পরিবেশের মধ্যে চলছে পঠনপাঠন। আরও কিছুটা এগোতে বোঝা যায়, রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশের মধ্যে চলছে আস্ত একটা স্কুল। যেখানে পড়ুয়াদের কোনও নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম নেই। পিরিয়ড মাত্র তিনটি। সপ্তাহে সাত দিনের বদলে স্কুল বসে চার দিন।
চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ও মেধাবী পড়ুয়াদের জন্য এমন ব্যবস্থা করেছেন স্কুলের প্রাক্তনীরাই। শতাব্দী প্রাচীন বালির জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ে টানা ১৭ বছর ধরে ওই অবৈতনিক নৈশ স্কুল চালাচ্ছে সেখানকারই প্রাক্তন ছাত্র সমিতি।
সোম, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার— সপ্তাহে এই চার দিনই সন্ধ্যা ৬টা বাজতেই পড়ুয়াদের মতো একে একে স্কুলে হাজির হন শিক্ষকেরাও। চারটি ঘর নিয়ে চলে সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির পঠনপাঠন। একতলারই আর একটি ঘরে বসে তিন ঘণ্টার অস্থায়ী টিচার্স রুম। রীতিমতো হাজিরা খাতায় ‘রোল কল’ করে বসা এই স্কুলে যে শুধু জোড়া অশ্বত্থতলারই ছাত্রেরা পড়তে আসে, এমন নয়। বালি-বেলুড়ের অন্যান্য স্কুলের ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে রাতের ওই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৫০। শিক্ষক প্রায় ১৪ জন। তাঁদের কেউ ওই স্কুলেই দিনে পড়ান, কেউ আবার অন্য স্কুলের স্থায়ী শিক্ষক। তালিকায় রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক থেকে অন্য পেশার মানুষেরাও। বেতন বলতে প্রতিটি ক্লাস শেষে এক ভাঁড় চা আর সঙ্গে নোনতা বিস্কুট।
রাতের এই স্কুল কেন?
প্রশ্নটা করতেই, পায়চারি থামিয়ে দাঁড়ালেন ছ’বছর আগে অবসর নেওয়া পদার্থবিদ্যার শিক্ষক মোহনলাল হালদার। তিনি বললেন, ‘‘ভাল ছাত্রছাত্রী তৈরি করার প্রচেষ্টা বলতে পারেন। সব কি আর অর্থের মূল্যে হয়।’’ ওঁর মতোই আরও কয়েক জন শিক্ষকের থেকেই জানা গেল, ২০০২ সালের শেষের দিকে রাজ্য সরকার নিয়ম করেছিল প্রাইভেট টিউশন করতে পারবেন না স্কুলের শিক্ষকেরা। তখন ওই স্কুলেরই উঁচু ক্লাসের ছাত্রেরা দাবি করেছিল, কিছু একটা ব্যবস্থা করা হোক। মোহনবাবু বললেন, ‘‘সেই বছর স্কুলের ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রাক্তন ছাত্র সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় একটি অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয় চালু করতে হবে।’’ শুরুটা তখন থেকেই। প্রথমে শুধু ওই স্কুলের পড়ুয়ারা সুযোগ পেলেও দু’-তিন বছর পরে সিদ্ধান্ত বদলান প্রাক্তন ছাত্রেরা। রাতের স্কুল খুলে দেওয়া হয় এলাকার অন্যান্য পড়ুয়াদের জন্যও। সেখানে পড়া মাধ্যমিকের কৃতী ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে স্কলারশিপের ব্যবস্থাও।
ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সমর ঘোষ বলেন, ‘‘বহুদিন আগে কিছু দিনের জন্য এই স্কুলে রসায়নের শিক্ষক ছিলাম। এখন আবার রাতের স্কুলে রসায়ন পড়াই।’’ প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে শুরু হয় স্কুল। ছকে বাঁধা পড়াশোনার বাইরেও পড়ুয়ারা সারা দিন কী কী উল্লেখযোগ্য কাজ করল, ইংরেজিতে তা নিয়ম করে ডায়েরিতে লিখতে হয়। তা আবার দেখে দেন শিক্ষকেরা। পড়াশোনা ঠিকমতো না করলে ডাকা হয় অভিভাবকদেরও। আবার রাতে ছুটির সময়ে অভিভাবক না এলে ছাত্রীদের ছাড়া হয় না বলে জানালেন সমিতির সভাপতি পাহাড়ি চক্রবর্তী।
এই স্কুলে পড়ে অঙ্ক, পদার্থবিদ্যার মতো কঠিন সব বিষয় এখন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে বলেও জানাল নবম শ্রেণির স্নেহা সরকার, রূপসা দাসেরা। আর জন্মগত হাঁটাচলায় অক্ষম অমিত ঘোষের বাবা প্রশান্তবাবুর কথায়, ‘‘খবরের কাগজ বিক্রি করে সংসার চালাই। প্রাইভেট টিউশন দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। তাই অষ্টম শ্রেণিতে এখানে ভর্তি করে দিয়েছি।’’ সমিতির সম্পাদক সুব্রত গোস্বামীর কথায়, ‘‘অর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা কিছু মেধাবী পড়ুয়ার পাশে দাঁড়ানোটাই এই কাজের মূল উদ্দেশ্য।’’
কথার মাঝে কেটেছে সময়। রাতের ক্লাস তখন শেষের পথে। ফের কানে ভেসে এল সুর মিলিয়ে পড়ুয়ারা বলছে, ‘‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে...’’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy