ওপারে দক্ষিণ ২৪ পরগনার অছিপুর। এ পারে হাওড়ার উলুবেড়িয়া ঘাটের ছবি। ছবি: সুব্রত জানা।
মাঝেমধ্যেই ঘটছে নৌকাডুবির ঘটনা। তাতে মৃত্যুও হচ্ছে। কখনও বা গ্রামবাসীদের সহায়তায় উদ্ধার করা হচ্ছে যাত্রীদের। কিন্তু বিপদ নিয়ে সচেতনতা দূরের কথা, অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে নৌকা পারাপার চলছেই। যাত্রী নিরাপত্তায় নজর বা কোনওরকম তদারকি নেই প্রশাসনেরও। যাত্রীদের অভিযোগ, দুর্ঘটনা ঘটলে দিন কয়েক টের পাওয়া যায় প্রশাসনের তত্পরতা। ফের যে কে সেই।
হাওড়া জেলায় হুগলি, দামোদর, রূপনারায়ণ ও মুণ্ডেশ্বরী এই চার নদীতে গ্রামীণ এলাকায় সরকারি ভাবে নথিভুক্ত ২৯টি ঘাট রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ঘাট পরিচালনা করে হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সংস্থা। বাকি ২৬টি ঘাট পরিচালনা করে হাওড়া জেলা পরিষদ। হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সংস্থার অধীন ঘাটগুলিতে লঞ্চ চলাচল করে। জেলা পরিষদ পরিচালিত ঘাটগুলিতে নৌকা ও ভুটভুটিই সম্বল।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁদের পরিচালিত ২৬টি ঘাটের মধ্যে হুগলি নদীর উপরেই রয়েছে ১৫টি ঘাট। দামোদরের উপরে রয়েছে ৫টি। রূপনারায়ণ নদীর উপরে ৪টি ও মুণ্ডেশ্বরী নদীর উপরে ২টি ঘাট রয়েছে। এই ঘাটগুলি থেকে কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুরে কোথাও নৌকা, কোথাও ভুটভুটি যাওয়া আসা করে। যেগুলির বেশিরভাগই পুরনো। তা ছাড়া প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বিপদের ঝুঁকি নিয়েই নিয়মিত অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণের অভিযোগ রয়েছে। যাত্রীদের অভিযোগ কখনও দক্ষ, আবার কখনও অদক্ষ, শিক্ষানবীস মাঝিরাই যাত্রী পারাপার করেন। বিপজ্জনক জেনেও নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছনোর তাগিদে বাধ্য হয়েই তাঁদের যাতায়াত করতে হচ্ছে। নৌকা পুরনো হয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ নিয়ে ঘাটগুলিতে নজরদারির বালাই নেই।
জেলা পরিষদের এক কর্তা জানান, নিয়মানুযায়ী ৪০ ফুটের বড় নৌকায় সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী বহন করা যেতে পারে আর মাঝারি নৌকায় ২০ থেকে ২৫ জন যাত্রী। কিন্তু দেখা যায় দুর্ঘটনার তোয়াক্কা না করেই নৌকাগুলিতে এর থেকে অনেক বেশি যাত্রী বহন করা হচ্ছে। যাত্রী পারাপারের নিয়মের যে কোনও ধার ধারেন না ঘাটমালিক ও মাঝিরা তার প্রমাণ পাওয়া গেল উলুবেড়িয়া ঘাটে। দিন কয়েক আগে এই প্রতিবেদকের সামনেই যতক্ষণ না নৌকা পুরোপুরি ভর্তি হয় ততক্ষণ তাতে যাত্রী ওঠাতে থাকলেন মাঝি। প্রতিবাদ করায় তাঁর দাবি, নিয়মমতোই যাত্রী নেওয়া হচ্ছে।
গত ২৫ জানুয়ারি জয়পুরের মুণ্ডেশ্বরী নদীতে কুলিয়া ঘাটে একটি ছোট নৌকা উল্টে গিয়ে ডুবে যায়। গ্রামবাসীদের তত্পরতায় যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ, নৌকাটিতে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী উঠেছিলেন। ২০১২ সালের জুন মাসে চেঙ্গাইলের নেপালি ঘাটে হুগলি নদীতে এক নৌকাডুবিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। ২০১০ সালে জানুয়ারিতে কোলাঘাটে রূপনারায়ণে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। কিন্তু বার বার দুর্ঘটনার পরেও নৌকায় যাত্রী পারাপারে যেমন ঘাটমালিক, মাঝিরা সচেতন হননি তেমনই এ ব্যাপারে প্রশাসনিক নজরদারি বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ যাত্রীদের। তাঁদের বক্তব্য, দুর্ঘটনা ঘটলে দিন কয়েক একটু নড়াচড়া হয় বটে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফের আগের অবস্থাই ফিরে আসে।
উলুবেড়িয়ার জগদীশপুরের বাসিন্দা অজয় মণ্ডল দক্ষিণ ২৪ পরগনার অছিপুরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। তাঁর কথায়, “রোজই আমাকে নৌকায় ওপারে যাতয়াত করতে হয়। হুগলি নদীর এই অংশ দিয়ে নিয়মিত জাহাজ চলাচল করে। সে ক্ষেত্রে নৌকা পরিবহণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। কিন্তু এটা ঘটনা যে, এ ব্যাপারে প্রশাসনিক নজরদারির প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। একে পারাপারের নৌকাগুলির বেশ কয়েকটি পুরনো। তার উপর যাত্রী নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম মানা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই জীবন হাতে নিত্য পারাপার করতে হচ্ছে।”
হাওড়া জেলা পরিষদের সহ সভাধিপতি অজয় ভট্টাচার্য বলেন, “হুগলি নদীর মতো বড় নদীতে নৌকা চালানো ঠিক নয়। কিন্তু মাঝিরা সেগুলিতেই যাত্রী পারাপার করেন। তা ছাড়া অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ নিয়েও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে হুগলি নদীর সমস্ত ঘাটে পিপিপি মডেলে লঞ্চ চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এতে বিপদের আশঙ্কা অনেকটাই কমবে।” তিনি আরও জানান, জেলায় বিভিন্ন নদীর ঘাটগুলিতে সতর্কতা মূলক বিজ্ঞপ্তি টাঙানোর পাশাপাশি মাঝিদের নিয়ে সেমিনার করে তাঁদেরও সচেতন করা হবে।”
প্রশাসনিক এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাঝি জানান, সব দোষ তাঁদের ঘাড়ে চাপালে তো চলবে না। জীবনের ভয় সকলেরই আছে। অনেক সময় যাত্রীদের বারণ করা হলেও তাঁরা জোর করে নৌকায় উঠে পড়েন তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য। তাঁদের বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy