বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় এসডিও অফিস চত্বর।
রোগটা সারল না ১২৮ বছরেও।
আধ ঘণ্টা টানা বৃষ্টি মানেই জলে টইটম্বুর এ শহরের পথঘাট। যাতায়াতে ভোগান্তি।
নগরায়ণের ধাক্কায় দ্রুত বদলাচ্ছে শহর আরামবাগ। বছর দুয়েক আগে রেল সংযোগ হয়েছে। উঠছে আবাসন। বাড়ছে হোটেল। নামী-দামি ব্র্যান্ডের দোকানে গমগম করছে ক্রেতা। কিন্তু নিকাশি ব্যবস্থা এখনও সেই তিমিরেই। এ জন্য পুরসভার বিরুদ্ধেই বারবার উদাসীনতার অভিযোগ তোলেন বাসিন্দারা। এ বারও বর্ষার মরসুমে ইতিমধ্যেই ডুবেছে শহরের ১২টি (১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৪ এবং ১৮ নম্বর) ওয়ার্ড।
১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ আমলে শহরের ১২টি ওয়ার্ড নিয়ে আরামবাগ পুরসভা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শহর। বর্তমানে ওয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮টিতে। মোট এলাকা ১১৭.২ বর্গ কিলোমিটার। পুরসভা গঠনের প্রথম থেকেই এ শহর অল্প বৃষ্টিতে জলে ভাসত। সমস্যাটা তারও আগের বলে মনে করেন পুরকর্তারা। কিন্তু সেই তথ্য পুরসভার কাছে নেই।
শহরের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন, এমন কয়েক জন জানিয়েছেন, বাংলায় সেন যুগেরও আগে এ শহরের নাম ছিল আরম্যনগর। গোঘাটের গড় মান্দারণ যখন মুঘল সম্রাটদের হাতে আসে, তখন শহরের নাম পাল্টে হয় জাহানাবাদ। মুঘল শাসনের পরে ফের নাম পাল্টায়। ১৯০০ সালের ২৫ অগস্ট ব্রিটিশ শাসকেরা নাম পাল্টে শহরের নতুন নামকরণ করেন ‘আরামবাগা’। সেই সময়ে এলাকায় অনেক বাগান থাকায় ওই নামকরণ বলে অনেকের ধারণা। পরে নাম হয় আরামবাগ। তখন সরকারি কর্মীদের ‘পানিশমেন্ট পোস্টিং’ বা শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে পাঠানো হত আরামবাগে। তখন এ শহর কুখ্যাত ছিল ম্যালেরিয়া আর কলেরার জন্য।
মশার উপদ্রব এ শহরে এখনও রয়েছে। বেহাল নিকাশি ব্যবস্থাকেই তার জন্য দায়ী করেন বহু বাসিন্দা। ভৌগোলিক ভাবে আরামবাগ নিচু এলাকা। শহরে ঢুকতে গেলে পেরোতে হবে দামোদর এবং মুণ্ডেশ্বরী নদী। শহর ছুঁয়ে বইছে দ্বারকেশ্বর। জমা জল শহরের বিভিন্ন নিকাশি-নালা এবং খাল হয়ে কানা দ্বারকেশ্বর খাল এবং দ্বারকেশ্বর নদীতে পড়ার কথা। কিন্তু তা হয় না। ফলে, অল্প বৃষ্টিতেই জল জমে শহরে। এ ছাড়া ডিভিসি-র ছাড়া জলে আরও এলাকা বানভাসি হওয়া তো আছেই।
শহরের কোর্ট রোডের নিকাশির জল গিয়ে পড়ছে দ্বারকেশ্বরে।
পুর কর্তৃপক্ষ মনে করেন, পরিকল্পনাহীন ভাবে শহর গড়ে ওঠার জন্যই প্রতি বর্ষায় এই বিপর্যয়। তা ছাড়া, এত দ্রুত যে শহরের আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডল বদলাবে, তা কারও ধারণা ছিল না। এখানে ১৮ কিলোমিটার পাকা এবং ১৭ কিমি কাঁচা নিকাশি-নালা রয়েছে। আরও ৩০ কিলোমিটার নালা করা হলে কিছুটা সুরাহা হবে। চেয়ারম্যান স্বপন নন্দীর দাবি, “সমস্যা মেটানোর জন্য একটি ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা তৈরি করা হচ্ছে। একটি মাস্টারপ্ল্যান রচনা করে পুরমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছি।”
কিন্তু পুর এলাকার বাসিন্দারা মনে করছেন, এ সমস্যা সহজে মেটার নয়। তাঁদের অভিযোগ, নিকাশি-নালা এবং খালগুলির উপরে যে ভাবে পরিকল্পনাহীন ভাবে নির্মাণ হয়েছে, প্রশাসনিক নজরদারির অভাবে খালবিলগুলিতে ছাই ফেলা হচ্ছে, পুকুর ভরাট করে দেওয়া হচ্ছে, তাতেই বর্ষার জল বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জমা জল বের হতে প্রায় পাঁচ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বছর বিরাশির ব্রজমোহন কুণ্ডু বলেন, “যতক্ষণ জমা জল না নামছে, স্বস্তি মেলে না। শহরে দীর্ঘদিন ধরে সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা নিয়েও সমস্যা আছে। সেই সব সমস্যার নিরসনে প্রচেষ্টা দরকার।”
তালতলা বাজার এলাকায় হাইড্রেন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ছবি: মোহন দাস।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আরামবাগ পুরসভা ছিল জনতা বোর্ডের দখলে। তা বামেদের দখলে আসে ১৯৮৬-তে। টানা ২৮ বছর বামেদের পক্ষে চেয়ারম্যান ছিলেন গোপাল কচ। বাম আমলে এ শহরে পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। সব ওয়ার্ডে আলোয় সুসজ্জিত কংক্রিটের রাস্তা, গরিবদের বাড়ি, সুলভ শৌচাগার, সুইমিং পুল, বোট ক্লাব, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, একাধিক শিশু উদ্যান, বেশ কিছু মার্কেট কমপ্লেক্স ইত্যাদি নানা চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন হলেও শহরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবিমতো বেহাল নিকাশির উন্নতি হয়নি।
তৎকালীন চেয়ারম্যান গোপাল কচ বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম মাটির নীচে দিয়ে নিকাশি-নালা করে শহরের জমা জল একদিকে কানা দ্বারকেশ্বর, অন্য দিকে দ্বারকেশ্বরে ফেলব। কিন্তু প্রয়োজনীয় তহবিল মেলেনি। প্রতি বছর কিছু মাটির কাজ করে নিকাশির অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়।” প্রায় একই পরিকল্পনায় এগোতে চাইছে বর্তমান পুরবোর্ডও।
চার জেলার কেন্দ্রবিন্দু এই শহর। দক্ষিণে বর্ধমান। দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁকুড়া। উত্তর-পশ্চিমে পশ্চিম মেদিনীপুর। উত্তরে পূর্ব মেদিনীপুর ও উত্তর-পূর্বে হাওড়া। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ নানা প্রয়োজনে এ শহর ছুঁয়ে যাতায়াত করেন। পেশাগত কারণে অনেকে থেকেও যান। তা ছাড়া, কামারপুকুর-জয়রামবাটি, চাঁদুর ফরেস্ট, পুড়শুড়ার বৌদ্ধমন্দির বা খানাকুলে রামমোহন রায়ের বাড়ি যেতে গেলেও ভ্রমণার্থীদের এ শহর ছুঁতে হয়। কিন্তু বর্ষার মরসুমে সেই যাতায়াত সহজ হয় না।
সেই দুর্ভোগেরই স্থায়ী সমাধান চান সকলে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy