হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তী।
আমি এখন অন্য দলে থাকলেও মেয়র-কালের কিছু কথা অবশ্য বলার আছে। যা সত্যি, তা ঢাকব কী করে? ২০১৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে প্রায় জোর করেই মেয়র করেছিলেন। এখন তিনি যে কথাই হাওয়ায় ভাসান না কেন! এক জন পেশাদার মানুষকে হাওড়ার মেয়রের চেয়ারে নিয়ে এসেছিলেন আমার উপরে ভরসা করেই। ভেবেছিলাম, স্বাধীন ভাবে কাজ করব। কিন্তু করতে পারলাম কই? এক জন ‘মিডলম্যান’ নিজের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে সারা ক্ষণ আমাকে পিছন থেকে টেনে ধরেছেন। অনেকটা কাঁকড়ার মতো।
তা সত্ত্বেও কাজের দিক থেকে অনেকটা এগিয়েছিলাম। পুরসভার বিভিন্ন প্রকল্পকে গুরুত্ব অনুযায়ী দু’ভাগে ভাগ করেছিলাম: ১) যেগুলি দ্রুত করে ফেলতে হবে এবং ২) যেগুলি একটু সময় নিয়ে করা যাবে। বলতে কোনও আপত্তি নেই, ওই সময়ে দু’জন মানুষ আমাকে গাইড করেছিলেন। এক জন তৎকালীন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং অন্য জন, প্রয়াত পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। রাতবিরেতে যখনই ফোন করেছি, সুব্রতদা আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন।
আমি মেয়র থাকাকালীন যে সমস্ত কাজ করেছি, তাতে ঠিক-ভুল, সবই ছিল। ভুল হবে না, শয়তান ছাড়া এমনটা কেউ বলতে পারে না। কংগ্রেস ও বাম আমল থেকেই হাওড়া ছিল অবহেলিত। তৃণমূল আসার পরে ভেবেছি, এই অবহেলা থেকে বেরোতে পারব। কিন্তু আমাদের দেশের একটা মূল সমস্যা হল, ‘মিডলম্যান’। নতুন কোনও আইন প্রণয়নই হোক বা চাষির ফসলের দাম নির্ধারণ— বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই সমস্ত ‘মিডলম্যান’। আমার মনে হয়, রাজনীতির জগতে এই মিডলম্যানেরাই উন্নয়নে সব থেকে বেশি সমস্যা তৈরি করছেন।
হাওড়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সকলেই অবশ্য খারাপ ছিলেন না। কিন্তু এক জন বিশেষ ব্যক্তি, যিনি নিজেকে হাওড়ার রূপকার বলে মনে করেন, তিনি আমার কাজে সব সময়ে বিঘ্ন ঘটিয়েছেন। তিনি নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য নিজের বাহিনী দিয়ে বিরক্ত করেছেন ক্রমাগত। তাঁর কিছু পারিষদ আছেন, যাঁরা নিজেদের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় সর্বদা আমার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে গিয়েছেন। আমার সম্পর্কে ভুল বোঝানো হয়েছে। ওই দলের উচ্চতর নেতৃত্বের দোষ হল, তাঁরা চোখের বদলে কান দিয়ে দেখেন। ক্রমাগত বিরোধিতায় যখন মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি, তখন শুভেন্দু অধিকারী আমাকে সাহস দিয়েছিলেন, যাতে পজ়িটিভ এনার্জি ফিরে পাই। আমি মনে করি, এ রাজ্যে শুভেন্দুবাবুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা অতুলনীয়।
নিজের অনতিদীর্ঘ মেয়র-কালে আমি কী কী করেছি, তা ইতিহাস বিচার করবে। হয়তো সব বিষয়ে একশোয় একশো পাইনি, তবে অনার্স নিয়েই পাশ করেছি।
আইসিইউ-তে পড়ে থাকা রোগীকে হাঁটাতে পেরেছি। আমার মতে, হাওড়ায় আমার কাজকে বিক্ষিপ্ত ভাবে, রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে হবে না। যেমন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বালিকে হাওড়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল বৃহত্তর স্বার্থের কথা
ভেবেই। মনে করা হয়েছিল, বালি-হাওড়া এক হয়ে গেলে একটা বড় জমি তৈরি হবে, তাতে উন্নয়নের কাজে এডিবি-র ঋণ মিলবে সহজে। যে কারণে কলকাতা ঋণ পেয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে দলের সেই ‘মিডলম্যান’ ও তাঁর পারিষদেরা ভুল বোঝানোয় মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলেন বালিকে ফের আলাদা করার।
হাওড়ায় সম্পত্তিকরের পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন কর ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পুরমন্ত্রীকে ওই ‘মিডলম্যান’ই ভুল বোঝালেন যে, মানুষের উপরে নাকি বেশি করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে! তাই সম্পত্তিকরের পুনর্মূল্যায়ন করেও পিছিয়ে যেতে হল। ফাঁসির আসামিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু আমার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান না দেখিয়ে, পুরসভায় কথা না বলেই ফিরহাদ হাকিম মহাশয় তা বাতিল করে দিলেন। এর ফলে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যাঁরা সম্পত্তিকর দেননি, তাঁরা বেঁচে গেলেন। মেয়র পারিষদ (অ্যাসেসমেন্ট) শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম জলে গেল। রাজস্ব না বাড়ায় পুরসভার আয়ও বাড়ল না। তবে আমার সমস্ত কাজে ও বিভিন্ন প্রকল্পের রূপায়ণে তৎকালীন কাউন্সিলর ও মেয়র পারিষদেরা যে ভাবে সাহায্য করেছেন, তাতে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।
ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের উন্নয়নে কী করা হয়েছে, মানুষ তা দেখেছেন। রিং রোড, কয়েকশো পার্ক, ত্রিফলা আলো, হাই মাস্ট আলোয় হাওড়া ভেসে গিয়েছে। প্রায় ১০ হাজার কর্মী নিয়োগ করে বিভিন্ন দফতরকে আরও কর্মক্ষম করা হয়েছে। কর্মসংস্থান বেড়েছে। স্বাস্থ্য দফতরকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। প্রচুর মহিলার চাকরি হয়েছে। পুরসভার উন্নয়ন আর রাজনীতি যে এক নয়, তা মানুষ বুঝতে পেরেছেন।
হাওড়ায় প্রচুর সবুজ ধ্বংস করা হয়েছিল। অথচ, হাওড়া শহরে দূষণ একটা ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। একটি গাছ অন্তত ৮০০ জন মানুষকে অক্সিজেন দেয়। আমি প্রতিটি এলাকায় নতুন পার্ক তৈরি করে বৃক্ষরোপণ করেছি। ২৬০টি পুকুরকে বাঁধিয়ে সংরক্ষণ করেছি। বাম আমলে যে ভাবে
বেআইনি বাড়ি তৈরি হচ্ছিল, আমার সময়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। নতুন প্ল্যানেটেরিয়াম করা হয়েছে। কিন্তু এখন ডুমুরজলায় খেল নগরীর জন্য সবুজ ধ্বংস করে স্থানীয় মানুষের ঘোরাফেরা ও খেলাধুলোর
অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
আমি রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে কাজ করেছি। স্রেফ হাওড়ার উন্নতির জন্য। কিন্তু ‘মিডলম্যানদের’ টানাহেঁচড়ায় তা বহু সময়ে ব্যাহত হয়েছে।
লেখক হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy