উত্তরপাড়া পুরসভা ছবি সংগৃহীত।
জন্মাবধি উত্তরপাড়ায় বসবাস আমার। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের উপর উত্তরপাড়ার জনপদকে দেখছি। বিপুল বদল হয়ে চলেছে এই অঞ্চলের। এতটা বদল পার্শ্ববর্তী পুরসবাগুলোতে হয়নি। এর কারণ উত্তরপাড়ার বেশ কিছু সুনাম। উত্তরপাড়া ঐতিহ্যবাহী স্থান। জমিদারদের অনেক কীর্তি ছড়িয়ে রয়েছে চার পাশে। জনসেবায় ব্যবহৃত হয় জমিদারদের বেশ কিছু প্রাচীন অট্টালিকা। একই সঙ্গে দেখেছে সরকারের উদাসীনতায় কিছু অট্টালিকা প্রোমোটারের গ্রাসে চলে গিয়েছে। যেমন ঘড়িবাড়ি। সে বাড়ির স্থাপত্য ছিল দেখার মতো। সরকার উদ্যোগী হয়ে অধিগ্রহণ করতেই পারত। হেরিটেজ তকমা পেত বাড়িটা। বদলে পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে সেখানে।
বহু মনীষীর পদার্পণ ঘটেছে উত্তরপাড়ায়। শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসাবে স্বীকৃত হয় এই অঞ্চল। গুন্ডামি-মস্তানির প্রকোপ খুবই কম। তাই উত্তরপাড়াকে বসবাসের জন্য বেছে নেয় মানুষজন। জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে বিপুল হারে। পুরনো বাড়ি ভেঙে, পুকুর, মাঠ বুঝিয়ে গড়ে উঠেছে প্রচুর হাউজিং কমপ্লেক্স। আমাদের পাড়াতেই ছিল চারটে পুকুর। চারটে পুকুর। একটা ডোবা। অবশিষ্ট আছে একটা পুকুর। তা-ও আয়তনে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
উত্তরপাড়ার আরও বড় দুটো আকর্যণ হচ্ছে, শহরের ধার বরাবর গঙ্গা। মানে হুগলি নদী। নদী এখানে বেশ চওড়া। দ্বিতীয় আকর্ষণ বেশি দিনের নয়। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। উত্তরপাড়া থেকে মিনিট পঁচিশেকের মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাওয়া য়ায়। ট্রেনে হাওড়া বা শিয়ালদহ মিনিট পনেরো-কুড়ির পথ। উত্তরপাড়াকে তাই বৃহত্তর কলকাতাই বলা যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমাদের ছোটবেলার সেই শান্ত নিরিবিলি মফস্সল শহরটা হারিয়ে গিয়েছে। শেষ জনগণনায় ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। সেটা নিশ্চয়ই ২ লাখ ছাড়িয়েছে। এখন।
আয়তনে উত্তরপাড়া খুব একটা বড় জায়গা নয়। এত স্বল্প পরিসরে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে পুর পরিষেবা দেওয়া সত্যিই খুব কঠিন। এই পুরসভার দায়িত্বে এত দিন ছিল তৃণমূল। অস্বীকার করার উপায় নেই, তারা নিজেদের সাধ্য মতো কাজ করে চলেছে।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, দীর্ঘ সময় ধরে সিপিএম চালিয়েছিল পুরসভা। খারাপ চালায়নি। বড় কোনও অভিযোগও ছিল না তাদের বিরুদ্ধে। তবে কিছু অসন্তোষ তো ছিলই। তাই বাম আমলেই তৃণমূল দখল করে উত্তরপাড়া পুরসভা।
রেললাইনের ও পারে অর্থাৎ উত্তরপাড়ার পশ্চিমে ‘মাখলা’ অঞ্চল অনেক পরে পুরসভায় যুক্ত হয়। আগে পঞ্চায়েতের আওতায় চিল। মাখলার রাস্তাঘাট, নিকাশি ব্যবস্থা, জলের জোগানের অনেক উন্নতি হলেও উত্তরপাড়ার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাটি আজও সুগম হল না। মোটামুটি দু’টি রাস্তা আছে যোগাযোগের। এক, রেলের লেভেল ক্রসিং, হাওড়া মেন লাইনের ব্যস্ত পথ। ট্রেনের আনাগোনা লেগেই আছে। ক্রসিংয়ের গেট এক বার পড়লে উঠতে চায় না। দ্বিতীয় রাস্তা, কাঁঠালবাগানে রেললাইনের নীচে আন্ডারপাস। বছরের বেশির ভাগ সময় সেখানে জল জমে তাকে। ওই দুই পথ এড়াতে অনেকে রেললাইনের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। যা অত্যন্ত ঝুঁকির।
বালি শহরের দিক থেকে এলে উত্তরপাড়া খালের উপর যে ব্রিজটি আছে, সেখানে পুরসভার একটি বড় বোর্ড দেখা যায়। অতিথিকে স্বাগত জানানোর বোর্ড। সেখানে ঘোষিত হয়েছে, উত্তরপাড়া পুরসভা সুবে বাংলা (বাংলা-বিহার-ওড়িশা ও অসম সমেত)-র মধ্যে প্রথম ও প্রাচীনতম স্থানীয় স্বায়ত্বশাসনমূলক প্রতিষ্ঠান।
উত্তরপাড়া পুরসভা স্থাপিত হয় ১৮৫৩ সালে। ১৮৫২ সালে জুন মাসে উত্তরপাড়া পুরসভা গঠনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। প্রথম পৌরসদস্যদের সভা আয়োজিত হয় ১৮৫৩ সালের ১৪ এপ্রিল। পৌরসভা স্থাপিত হওয়ার পর নিযুক্ত করা হয়। চার জন চৌকিদার ও সাত জন পাইককে, যাঁরা এলাকার শান্তি বজায় রাখবেন এবং কর আদায় করবেন। এখানে পুলিশের আউটপোস্ট তৈরি হয় ১৮৭৫ সালে। ২ হাজার ৭২ টাকা খরচ করে। পরে ১৯১৬ সাল সেটা পুরোপুরি থানা রূপে স্বীকৃতি পায়। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত পুলিশের খরচা দেওয়া হত উত্তরপাড়া পুরসভা থেকে।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে উত্তরপাড়া (তখন ‘ওতোরপাড়া’ বলা হত) ছিল এক অখ্যাত, খানিকটা অবহেলিত জনপদ। উত্তরপাড়া বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিচিতি পেতে শুরু করে জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। উনি এখানে একের পর এক বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্ত্রী শিক্ষার প্রথম প্রয়াস শুরু হয় তাঁর উদ্যোগেই। জয়কৃষ্ণের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান, গঙ্গার ধারে উত্তরপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি। তৎকালীন সরকারের কোনও সাহায্য পাননি। একক প্রয়াসে ১২ হাজার গ্রন্থ সংগ্রহ করেন। প্রায় ৮৫ হাজার টাকা ব্যয় করে জয়কৃষ্ণ নির্মাণ করেন বীণাপাণি মনোরম পুস্তক-আলয়। গঙ্গাতীরে এটি একটি দ্রষ্টব্য অট্টালিকা।
এই লাইব্রেরির অনুষঙ্গে বহু শিক্ষাব্রতী বিশিষ্টজনের আগমন ঘটেছে উত্তরপাড়ায়। যেমন, রেভারেন্ড জেমস লং, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মেরি কার্পেন্টার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, কাজি নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেকে। উত্তরপাড়ায় শ্রী অরবিন্দের বক্তৃতা স্মরণযোগ্য একটি ঘটনা।
এই শহরের অলিতে-গলিতে-বাড়িতে অজস্র ইতিহাস ছড়িয়ে আছে। এটাকে রক্ষা করার দায় যেমন নাগরিকের, তেমনই পুরসভার সহায়তা ভীষণ দরকার। এখানে বিশিষ্টজনেদের নামে যে রাস্তাগুলি আছে, তার মুখে পুরসভা বোর্ড লাগিয়েছে। তাতে সেই বিশিষ্ট ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া আছে। উত্তরপাড়ার নেতাজিভবনটি প্রায় ভেঙে পড়েছিল। সেটির পুনর্নির্মাণ হয়েছে। উত্তরপাড়া পুরভবনটিও আগের থেকে এখন অনেক ঝকঝকে। সংলগ্ন গণভবন হলটি প্রচুর ব্যয়ে পুনর্নির্মিত হয়েছে। উত্তরপাড়ার যাবতীয় বড় ধরনের অনুষ্ঠান এই গণভবনে অনুষ্ঠিত হয়। জিটি রোড উত্তরপাড়ার প্রধান রাস্তা। এর পরিসর উত্তরপাড়ায় ভীষণ কম। জ্যাম লেগেই থাকে। রাস্তায় এসে পড়ে দোকান-বাজার। পুরসভার পক্ষ থেকে তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায় না জিটি রোডকে প্রশস্ত রাখার ব্যাপারে। শহরের ভিতরের রাস্তাগুলি চওড়া করা হয়েছে। ফুটপাথও তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই পথ ধরে মানুষ হাঁটতে পারছে না। কেন না পুরসভা সেখানে সিমেন্টের বড় বড় টব বসিয়েছে। গাছ লাগানো হয়েছে তাতে। এমত অদ্ভুত পরিকল্পনার কারণ হয়তো ফুটপাথকে হকারদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। ফাঁকা থাকলেই তো গুমটি দোকান বসে যাবে। অর্থাৎ ফুটফাত হল, কিন্তু হাঁটা গেল না।
বেশ কিছু ওপেন জিম তৈরি করে দিয়েছে পুরসভা। এ সবই বছর দু’একের মধ্যে বানানো। জিমগুলির কোনও রক্ষণাবেক্ষণ চোখে পড়ে না। এক বার ভেঙে গেলে সারানো হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যেমন, মনমোহন উদ্যানের যে পার্কটি নির্মাণ করেছিল পুরসভা, তার দুটো রাইড বছরখানেকের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে। আর সারানো হয়নি।
পরিশ্রুত জল সরবরাহে উত্তরপাড়া পুরসভা এখন অনেকটাই সাবলম্বী। ওয়াটার প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে। আর একটা উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। বাড়ি বাড়ি থেকে সংগৃহীত পচনশীল বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে সার।
গঙ্গার তীরের সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে। সেখানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভাঙন। নদীর ভাঙন এখন উত্তরপাড়া-সহ আরও অনেক শহরের সমস্যা। ইতিমধ্যেই গঙ্গার পাড় ঘেঁষা ফ্ল্যাট-বাড়িগুলির বেশ ক’টাতে ফাটল দেখা দিয়েছে। উত্তরপাড়ার শিবতলার শ্মশানঘাট বারে বারে বাঙছে। সারিয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আবার এই গঙ্গার পাড়েই তৈরি হয়েছে পুরসভার গেস্টহাউস ‘ভোরের আলো’। স্বল্পমূল্যে নানা অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়। বাড়িটি দেখতে খুব সুন্দর। শীতাতপের ব্যবস্থা আছে। নাগরিকদের যথেষ্ট উপকারে লাগে বাড়িটি। উত্তরপাড়ায় রাত্রিবাসের হোটেল ছিল না। এখানে রুম ভাড়া পাওয়া যায়। অনুষ্ঠানবাড়ির জন্য একটাই অসুবিধা। গাড়ি রাখার প্রশস্ত জায়গা নেই। বাড়িটা গঙ্গার পাড়ে হওয়ার কারণে একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। ভাঙনের কবলে না পড়ে। আইন অনুযায়ী, নদী তীরের কত মিটার দূরে যেন কনস্ট্রাকশন করা যায়! এখানে সে সব কখনও মানা হয়নি। উত্তরপাড়ায় ফিল্ম সিটির কথা ভাবা হয়েছিল, এই বাঙন দেখেই পরিকল্পনা মুলতুবি রাখা হয়েছে।
‘মহামায়া শিশু ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র’কে আধুনিকিকরণ করা এখনকার পুরকর্তৃপক্ষের একটি সাধুবাদযোগ্য কাজ। আগে এটি সাধারণ প্রসূতি সদন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
ভদ্রকালী-কোতরং অঞ্চলে উত্তরপাড়ার রূপ ক্রমশ পাল্টে গিয়েছে। এখন সেখানে বড় বড় বিল্ডিং কমপ্লেক্স, শপিং মল, আইনক্স, হওয়া শুধু বাকি। নিজের এলাকাটাকেই আজকাল বড় অচেনা লাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy