স্মৃতি: এক অনুষ্ঠানে বন্ধু ও সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে রমাপদ চৌধুরী। ফাইল চিত্র
দেশ পত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে আনন্দবাজারের বাড়িটায় তখন আমার যাতায়াত শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন আমাকে কাছে ঘেঁষতেই দেননি রমাপদ চৌধুরী।
তার অনেক আগে থেকেই আমি অবশ্য ওঁর লেখার ভক্ত। জলপাইগুড়িতে লাইব্রেরি থেকে নেওয়া একটি সঙ্কলনে ওঁর ‘তিতির কান্নার মাঠ’ গল্পটা পড়ে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এখনও মনে আছে, গল্পের নায়িকার নাম অরুণিমা সান্যাল। আনন্দবাজার পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’-এর জন্য প্রথম বার ওঁর কাছে যে-গল্পটা নিয়ে গিয়েছিলাম, তার নায়িকার নামও রেখেছিলাম ‘অরুণিমা সান্যাল’।
আমি তো ভেবেছিলাম, নায়িকার নাম দেখেই রমাপদ চৌধুরী গল্পটা পছন্দ করে ফেলবেন। কিন্তু উনি সেই গল্প পড়েও দেখেননি। ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে যাওয়া-আসার সুবাদে তত দিনে বিমল কর, সাগরময় ঘোষেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। জানতাম, ওঁদের ঘরে যাতায়াতের পথেই কোন ঘরটায় বসে রমাপদদা বসেন। কিন্তু গল্প নিয়ে প্রথম বার ওঁর মুখোমুখি হয়ে খানিকটা ধাক্কাই খেয়েছিলাম।
উনি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবছেন, আমি ঘরে ঢুকে বলেছিলাম, আমি দেশ-এ লিখি। একটা গল্প নিয়ে এসেছি। উনি চোখ বন্ধ করেই বললেন, ‘গল্পটা দেশ পত্রিকাতেই নিয়ে চলে যান!’ এক জন নবীন লেখক হিসেবে ওঁর সেই ব্যবহারে আমি তো হতবাক! খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে বিমলদা-সাগরদাদের সবটা বলতে ওঁদের কী হাসি! রমাপদদা মানুষটা এমনই।
আরও পড়ুন: টিয়ারঙের দ্বীপ ছাড়িয়ে চলে গেলেন রমাপদ চৌধুরী, বয়স হয়েছিল প্রায় ৯৬
তখন বুঝিনি, এই আপাতরুক্ষ স্বভাবের আড়ালে আসল রমাপদ চৌধুরী একেবারে অন্য রকম। ঠিক যেন নারকোলের স্বভাব। সহজে যার ভিতরে ঢোকা যায় না। কিন্তু এক বার ঢুকতে পারলেই শাঁসজলের অফুরান সন্ধান। ১৯৬৭-তে প্রথম বার দেশ পত্রিকায় আসার পরে ওঁর কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম সেই ১৯৭৮-এ। সেই প্রথম সাক্ষাতের পরে ওঁকে আমি এড়িয়েই চলতাম। এক দিন আনন্দবাজারে ঢোকার মুখে দেখা হতেই হঠাৎ ফস করে বললেন, একটা লেখা দেবেন তো! দাঁড়ালেন না, তাকালেন না, নাম ধরেও ডাকলেন না। স্রেফ লেখাটা দিতে বলেই চলে গেলেন। পরে ওঁর খানিকটা কাছাকাছি যখন এসেছি, তখন অনুযোগও করেছি, এই রুক্ষ হাবভাব নিয়ে। উনি নির্বিকার! ‘আমার স্বভাব!’ তখন কিন্তু অফিসে দেখা হলেই হাঁক দিতেন, ‘বিকেলে মুড়ি খেয়ে যাবে!’
তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণদের থেকেও আমায় নাড়া দিয়েছিলেন পরের প্রজন্মের কয়েক জন সাহিত্যিক। উপন্যাসের ক্ষেত্রে যদি সমরেশ বসুর থেকে শিখি, কী করে গল্প লিখতে হয়, সেটা শিখেছি বিমল কর ও রমাপদ চৌধুরীকে পড়েই। অথচ দেখতাম, অত বড় এক জন লেখক নিজের লেখা নিয়ে কতখানি নির্মোহ! বছরে এক বারই লিখতেন। দেশ বা আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যায়। এক বার তো বলেই দিলেন, ‘ভাল লাগছে না, আর লিখব না! সবাই রিটায়ার করে, লেখক কেন করবে না?’
তখন ওঁর বয়স সত্তরের কোঠায়। ভারতীয় লেখকদের মধ্যে এমন বড় একটা দেখা যায় না। অনেক পরে আত্মজীবনীমূলক কিছু লেখা লিখেছেন। ভূগোলের নিরিখে খুব বড় পরিসর ওঁর লেখায় ধরা পড়েনি। কিন্তু মানুষের সম্পর্কের কথা
এতটা গভীর ভাবে খুব কম লেখকই বলতে পেরেছেন।
Tag: headm2
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy