শুভেন্দু কি দেড় বছরেই দিলীপকে ছাপিয়ে যেতে বসেছেন? নিজস্ব ছবি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন দিলীপ ঘোষের গাড়িতে হামলা রাজ্য-রাজনীতিতে বহুচর্চিত বিষয় ছিল। এই সে দিনও দিলীপ একটি চ্যানেলে বলেছেন, ‘‘অন্তত ২০-২২ বার হামলা হয়েছে!’’ স্পষ্টতই তাঁর ইঙ্গিত রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের দিকে। দিলীপের গাড়ি ভাঙা বা তাঁকে মারধরের ঘটনাকে ‘রাজ্য সভাপতির অতি সক্রিয়তার জের’ হিসাবেই দেখত পদ্মশিবির। তা নিয়ে তাদের ‘গর্ব’ও ছিল। এখন অবশ্য কার্যত ‘গা-সওয়া’ হয়ে গিয়েছে দিলীপের গাড়িতে হামলার ঘটনা। পরিবর্তে, বিজেপির অন্দরে এখন আলোচনার বিষয় দলের বিধায়ক তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা। দলেরই কেউ কেউ রসিকতা করে বলছেন, ‘‘শুভেন্দু দেড় বছরেই দিলীপকে ছাপিয়ে যেতে বসেছেন!’’
সংখ্যাতত্ত্বের বিচারও অনেকটা তেমনই বলছে অবশ্য। শুভেন্দু প্রায়শই দাবি করে থাকেন, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় দু’ডজন মামলা করেছে শাসকদল। বিরোধী দলনেতা এ-ও দাবি করেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। যদিও শাসক তৃণমূল আগাগোড়া বলেছে, ‘আইনবিরুদ্ধ’ কাজ করলে মামলা হবেই। এর সঙ্গে ‘প্রতিহিংসা’র রাজনীতির কোনও যোগ নেই। বরং, বিজেপিই ইডি-সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে ‘প্রতিহিংসা’র রাজনীতি করছে।
রাজ্য স্তরের এক পদ্মনেতার কথায়, ‘‘দিলীপদার গাড়িতে যে কত বার হামলা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই!’’ দিলীপ-ঘনিষ্ঠ এক নেতাও বলেন, ‘‘উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া, মুর্শিদাবাদের কান্দি থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, শীতলখুচি— কত বার যে দিলীপ’দার গাড়ির কাচ বদলাতে হয়েছে, গুনে বলা যাবে না!’’ তবে একটা সময়ের পর দিলীপ নিজেও হামলা নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
অন্য দিকে, শুভেন্দু সম্প্রতি দাবি করেছেন, তিনি এবং তাঁর ভাই সৌমেন্দু অধিকারী (কাঁথি পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান)-র বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ২৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে বিরোধী দলনেতা দাবি করেছিলেন, ‘‘নন্দীগ্রামের ফল ঘোষণা পর থেকে আমার এবং আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মোট ২৯টি মামলা দায়ের করেছে রাজ্য সরকার। তার মধ্যে আমার বিরুদ্ধে ২১টি মামলা আর আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৮টি।’’
তার পরেও শুভেন্দুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। গত অক্টোবরে বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার থানায় ‘ঘৃণাভাষণ’-এর মামলা দায়ের করেছেন এক আইনজীবী। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশের কথা উল্লেখ করে শুভেন্দুকে গ্রেফতারেরও দাবি জানিয়েছেন তিনি। গত সপ্তাহে শুভেন্দুর ‘কুমন্তব্য’-এর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা। থানায় অভিযোগপত্র দিয়ে আদিবাসী নিপীড়ন প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করার আবেদন করেছেন বিরবাহা। যদিও সেই আবেদনের ভিত্তিতে কোনও মামলা দায়ের হয়েছে কি না, তা এখনও জানা যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য-রাজনীতিতে সব চেয়ে বেশি আলোড়ন ফেলেছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলের জন্মদিন উদ্যাপন নিয়ে শুভেন্দুর টুইটের প্রেক্ষিতে মামলা। সমাজমাধ্যমে ‘বিভ্রান্তিমূলক’ তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে পকসো ধারায় বেলেঘাটা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন এক মহিলা।
শুভেন্দুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন অভিষেকের বাবা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ওই মামলায় বিরোধী দলনেতাকে আগামী ১ ডিসেম্বর আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বিধাননগর পুরসভার তৃণমূল মেয়র পারিষদ দেবরাজ চক্রবর্তীও। সার্বিক ভাবে এ প্রসঙ্গে শুভেন্দুর বক্তব্য, ‘‘আদালতে কেউ যেতেই পারেন। তা নিয়ে কিছু বলার নেই।’’
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষও নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন। কুণালের অভিযোগ, তাঁকে ‘বাবার ত্যাজ্যপুত্র’ বলে অপমান করেছেন শুভেন্দু। তার প্রেক্ষিতেই নিম্ন আদালতে মানহানির মামলা করেছেন তৃণমূল নেতা। নিম্ন আদালত শুভেন্দুকে ওই মামলায় হাজিরা দেওয়ারও নির্দেশ দেয়। এর পর মামলাটি খারিজের আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন বিরোধী দলনেতা। উচ্চ আদালতের নির্দেশ, আপাতত কুণালের মামলায় শুভেন্দুকে হাজিরা দিতে হবে না।
এর পরেও নন্দীগ্রামে তৃণমূলের শহিদ দিবসের মঞ্চে আগুন লাগানোর অভিযোগে গত ১১ নভেম্বর শুভেন্দু-সহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শুভেন্দু এবং তাঁর ভাই সৌমেন্দুর বিরুদ্ধে কাঁথি পুর-ভবন থেকে ত্রিপল চুরির মামলাও আদালতে বিচারাধীন।
গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক পর পরই প্রাক্তন দেহরক্ষী শুভব্রত চক্রবর্তীর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর মামলাতেও শুভেন্দুর নাম জড়িয়েছে। শুভব্রতের স্ত্রী সুপর্ণা কার্যত শুভেন্দুর বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ তুলে কাঁথি থানায় এফআইআর করেন। তার প্রেক্ষিতে খুনের মামলা রুজু হয়েছে। আপাতত মামলাটি হাই কোর্টে বিচারাধীন।
শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, বিরোধী দলনেতা হিসাবে শুভেন্দু নানা বিষয়ে রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজের দল এবং কর্মী-সমর্থকদের পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। একের পর এক মামলা তারই ‘পাল্টা প্রতিক্রিয়া’। চাপে রাখতে কিছু ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগ তুলে বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। শুভেন্দুরও দাবি, শুধু ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ চরিতার্থ করতেই সরকারি কোষাগার থেকে ২০ কোটি টাকা খরচ করে তাঁর এবং তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকার। যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল বলছে, শুভেন্দুর ওই দাবির কোনও প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত, আইন আইনের পথেই চলবে। তৃণমূলের এক রাজ্য স্তরের নেতার কথায়, ‘‘শুভেন্দু সত্যিই নির্দোষ হলে তো তাঁর ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই! সারদা এবং নারদ-কাণ্ডে নাম থাকা সত্ত্বেও শুভেন্দুকে ডাকছে না কেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা? প্রসঙ্গত, সারদা এবং নারদ মামলায় কেন শুভেন্দুকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না, সেই প্রশ্ন তুলে কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়েছিল। সেটি খারিজ করে দেয় উচ্চ আদালত।
দিলীপের মতো তাঁকেও যে ‘জব্দ’ করতেই পর পর মামলা দেওয়া হচ্ছে, তা শুভেন্দুও বিলক্ষণ জানেন বলে দাবি করেছেন বিজেপির আর এক নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘দিলীপ এবং শুভেন্দু দু’জনের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। দু’জনেই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে চলেন। কিন্তু শুভেন্দু যে হেতু বিরোধী দলনেতা, ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমতুল্য, তাই তাঁর গাড়িতে হামলা হয় না। শুধু মামলাই হয়।’’ চরিত্রে সাদৃশ্য থাকলেও দুই নেতার মধ্যে তুলনা টানতে চাইছেন না কেউই। ওই নেতার কথায়, ‘‘দু’জনেই নিজেদের জায়গায় সফল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy