স্বীকৃতি: শিল্পপতি পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
রাজস্থানের ইতিহাসে ছিল আরাবল্লী পাহাড়ে হলদিঘাটির যুদ্ধ। আর বাংলার ইতিহাসে হলদি নদীর ধারে হলদিয়ার যুদ্ধ। প্রথমটা ষোড়শ শতকে কামান, বন্দুক, তরবারি, ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে। দ্বিতীয়টা এই সে দিন, বোর্ডরুমে। ডাউনস্ট্রিম, পলিয়েস্টার ফাইবার, অংশীদারির হিসাব নিয়ে। রাণা প্রতাপের মতো ‘নীল ঘোড়ে কি সওয়ার’ তিনি ছিলেন না, কিন্তু ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বিস্তারের নীল নকশা ছিল।
সেই হলদিয়া পেট্রোকেম-এর প্রাণপুরুষ পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় এ বার সেরার সেরা বাঙালি। যুদ্ধটা যে তাঁর কাছেও স্মরণীয়, সে কথা বোঝা গেল শনিবার সন্ধ্যার অনুষ্ঠানেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার পরে সঞ্চালক শিল্পপতিকে জিজ্ঞেস করছিলেন, জীবনে সবচেয়ে বড় বাধা কোনটা ছিল! চিন থেকে আমেরিকা সর্বত্র বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা নিয়ে পূর্ণেন্দুবাবুর ছোট্ট উত্তর— হলদিয়া।
তার একটু আগেই লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট-এ সম্মানিত হয়েছেন অপর্ণা সেন। নায়িকা থেকে পরিচালক কত ভূমিকাতেই যে বাঙালি দেখেছে ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ীকে! ‘যুগান্ত’ ছবির পরিচালক এ দিনও এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, বেঙ্গালুরুতে গৌরী লঙ্কেশ ও শ্রীনগরে শুজাত বুখারির মৃত্যু তাঁকে কী ভাবে ধাক্কা দিয়েছে!
অপর্ণা থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেকের নায়িকাকেই আভরণে সাজিয়েছেন যিনি, অভিষেক-ঐশ্বর্যার বিয়েতেও জয়া বচ্চন যেখানে গয়না কিনতে আসেন, সেই অলঙ্কার বিপণির কর্ণধার অনন্যা চৌধুরীই এ বার বাণিজ্যে সেরা বাঙালি। শুধু বিয়ের গয়না বানিয়ে থেমে যাননি। পোড়ামাটির উপরে হাল্কা সোনার কাজে, মধ্যবিত্তের পকেটবান্ধব গয়নাও তো নিয়ে এসেছেন এই নারী। গয়নার ডিজাইনে এক বার চমকে দিয়েছিলেন ইটালির মিলান শহরকেও। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব সেরা বাঙালিই আসলে বিশ্বায়িত বাঙালি।
আরও পড়ুন: ‘ঠাঁইহারা’ ছাত্রীর পাশে বিশ্ববিদ্যালয়
সাহিত্য? ইন্টারনেটের তুমুল চাহিদায় ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’ ছাপা বই হয়ে বেরোনোর কথা সকলের জানা। কিন্তু ‘দেশ’ পত্রিকায় কয়েক দশক আগে তাঁর প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’-এর কথাই বা বাঙালি ভুলবে কী ভাবে? সেই ধারাবাহিক শেষ হতেই সম্পাদক সাগরময় ঘোষের ডাক লেখককে। এক তাড়া চিঠি নিয়ে লেখককে দেখিয়েছেন তিনি, ‘আরে, লোকে বলছে আমি বুর্জোয়া কাগজের সম্পাদক বলে তোমার লেখা মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় পর্ব ভাবো।’ তার পরই তো তাঁর কলম থেকে বেরোবে ‘কালবেলা’— শিয়ালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে অনিমেষ আবিষ্কার করবে, বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা। সমরেশ মজুমদারই যে এ বার সাহিত্যে সেরা বাঙালি, আঁচ করার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।
সম্মানিত: সেরা বাঙালির মঞ্চে ( বাঁ দিক থেকে) ঈশান পোড়েল, অনন্যা চৌধুরী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অরিজিৎ সিংহ, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, শাঁওলী মিত্র এবং অপর্ণা সেন। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
তাঁর ‘বঙ্গবালা’র দিকে তাকিয়েই ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’য় ঋত্বিকের ঠোঁটে দেবব্রতর গান, ‘কেন চেয়ে আছ গো মা।’ ছোটবেলায় ‘ডাকঘর’-এর অমল, তার পর ‘নাথবতী অনাথবৎ’-এর একক অভিনয়ে বাঙালিকে চমৎকৃত করা। তার পরও ‘বিতত বিতংস’ বা সার্ত্রের নাটক অবলম্বনে ‘একটি রাজনৈতিক হত্যা’। শাঁওলী মিত্রের হাতে নাট্যকলায় সেরা বাঙালির সম্মান তুলে দিলেন বিভাস চক্রবর্তী।
‘চক দে ইন্ডিয়া’ থেকে ‘বাজিরাও মস্তানি’ বা ‘পদ্মাবত’, বলিউড-কাঁপানো অনেক ছবিতেই তাঁর সিনেমাটোগ্রাফি। সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে সিনেমার সেরা বাঙালির সম্মান তুলে দিলেন জয়া আহসান। এ পার বাংলা-ও পার বাংলা থেকে মুম্বই সব মিশে গেল সেরার মোহনায়। সঙ্গীতে সেরা: অরিজিৎ সিংহ। জিয়াগঞ্জের এই ছেলের গানই তো কখনও শোনা যায় আমিরের ‘দঙ্গল’, কখনও বা শাহরুখের ‘রইস’ ছবিতে।
সাহিত্য, নাটক, সিনেমার পাশাপাশি এল চিত্রকলাও। সেখানে অধুনা দিল্লিপ্রবাসী যে বাঙালি ছবির জল রঙে বারংবার ধরা পড়েছে কলকাতার নিসর্গ, সেই সঞ্জয় ভট্টাচার্যই এ বারের সেরা বাঙালি।
সেরার সম্মান পেলেন টিন-এজার এক বাঙালিও। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর তিনি পা দেবেন কুড়ি বছরে, কিন্তু তার আগেই বল হাতে মাতিয়েছেন বাইশ গজের ক্রিকেট পিচ। এ বার ক্রীড়াক্ষেত্রে সেরা বাঙালির নাম ঈশান পোড়েল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy