সংঘাত কি চরমে উঠল? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজ্যপালের সঙ্গে শুক্রবার সরাসরি সংঘাতে চলে গেল নবান্ন। মাধ্যম: বৃহস্পতিবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যদের পাঠানো রাজভবনের একটি নির্দেশিকা। যা রাজ্যপালের তরফে পাঠানো হয়েছে ‘আচার্য’ হিসাবে। সেই নির্দেশিকা নিয়ে শুক্রবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রকাশ্যেই রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে লক্ষ্য করে আক্রমণ শানিয়েছেন। শুধু প্রকাশ্যে রাজভবনের বক্তব্য খণ্ডনই নয়, ওই নির্দেশিকা নিয়ে আইনজ্ঞদের সঙ্গেও পরামর্শ করছে রাজ্য শিক্ষা দফতর। তার আগে ব্রাত্য রাজভবনকে বলেছেন, ওই নির্দেশ (বা চিঠি) প্রত্যাহার করতে। ব্রাত্য বলেন, ‘‘ওই চিঠির বৈধতা আছে কি না, তা দেখতে হবে। আমি উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিবকে আইনি পরামর্শ নিতে বলেছি।’’ বস্তুত, ব্রাত্য ওই নির্দেশটিকে ‘বেআইনি এবং অনৈতিক’ বলেও অভিহিত করেছেন। ওই নির্দেশে বলা হয়েছে, সমস্ত আর্থিক বিষয়ে উপাচার্যেরা যেন আচার্য তথা রাজ্যপালের অনুমতি নেন। উপাচার্যেরা যেন সরাসরি রাজ্যপালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, সেই নির্দেশও দেওয়া হয়েছে ফোন নম্বর এবং ইমেল আইডি-সহ। তাতেই ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়েছে নবান্ন। ব্রাত্যের বক্তব্য যার প্রমাণ। বস্তুত, রাজ্যপালের কাজকর্মে রাজ্য সরকার যে ক্ষুব্ধ, তা-ও গোপন করা হয়নি। কারণ, ব্রাত্য প্রকাশ্যেই রাজ্যপাল সম্পর্কে তাঁর যাবতীয় বক্তব্য জানিয়েছেন।
ব্রাত্য যে ভাবে রাজ্যপাল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, তা ‘আক্রমণাত্মক’ তো বটেই, মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, তিনি সরাসরি রাজ্যপালের মোকাবিলায় নেমেছেন। সংঘাতের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘হেড অন’!
নবান্ন সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার মনে করছে, রাজ্যপাল ‘অতিসক্রিয়’ ভূমিকা পালন করছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অধিকারের সীমাও লঙ্ঘন করছেন। ফলে এ বার সরাসরিই সেই ‘অতিসক্রিয়তা’র মোকাবিলা করবে নবান্ন। অনেকের মতে, ব্রাত্য যে ভাষায় রাজ্যপাল বোসকে আক্রমণ করেছেন, তা সঙ্গে খানিকটা মিল রয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। ব্রাত্য প্রাক্তন দুই রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী এবং জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে বোসের তুলনা করেছেন। যা অহরহ করে থাকেন শুভেন্দুও। যদিও ব্রাত্যের ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, গোপালকৃষ্ণ-ধনখড়ের পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রী আর এক প্রাক্তন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গেও বর্তমান রাজ্যপালের তুলনা করেছেন। ফলে তাঁর বক্তব্য আর শুভেন্দুর বক্তব্য একেবারেই মেলে না।
প্রসঙ্গত, রাজ্যপালের সঙ্গে প্রথমে নবান্নের সম্পর্ক ভালই ছিল। ক্রমশ তা অম্লমধুর হয়ে পড়ে। বৃহস্পতি এবং শুক্রবারের ঘটনাপ্রবাহ বলছে, সেই সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কারণ, ব্রাত্য যে ভাবে রাজ্যপাল তথা রাজভবনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন, তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমোদনক্রমে হয়েছে বলেই প্রাশাসনিক আধিকারিকদের অভিমত। সেই সংঘাতে নবান্ন তথা রাজ্য সরকার রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ‘রণং দেহি’ মনোভাবই নিয়েছে।
সরকার তো বটেই, তৃণমূলও রাজ্যপালের ওই নির্দেশের বিরোধিতা করছে। দলের প্রবীণ সাংসদ তথা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৌগত রায় বলেন, ‘‘আচার্য হিসাবে উপাচার্যদের থেকে সরাসরি রিপোর্ট চাইতেই পারেন রাজ্যপাল। কিন্তু খরচে নিয়ন্ত্রণ চাইতে পারেন না। এটা বৈধ নয়।’’ অন্য দিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘বাংলায় যে কোনও বিষয়েই আর্থিক অস্বচ্ছতা আছে। আচার্য হিসাবে তিনি (রাজ্যপাল) তার উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইতেই পারেন। এতে কোনও বাধা নেই। আর সরকার বা তৃণমূল এত ভয়ই বা পাচ্ছে কেন? এখানেই তো লুকিয়ে নিয়ন্ত্রণের কারণ।’’
জগদীপ ধনখড়ের পর সিভি আনন্দ বোস বাংলায় দায়িত্বে আসার পরে তাঁর সঙ্গে ভাল সম্পর্কই ছিল নবান্নের। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের সঙ্গে প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতার সম্পর্কের উন্নতিও দেখেছিল বাংলা। মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরস্বতী পুজোর দিন বাংলায় হাতেখড়ি হয়েছিল রাজ্যপালের। যা নিয়ে রাজ্যপালকে ধারাবাহিক ভাবে আক্রমণ করে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সেন্ট জ়েভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে সাম্মানিক ডি-লিট প্রদান অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল তাঁর বক্তব্যে অটলবিহারী বাজপেয়ী, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, উইনস্টন চার্চিল, এপিজে আব্দুল কালামের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মমতাকে এক বন্ধনীতে রেখে প্রশংসা করেছিলেন। তার পরেই শুভেন্দু টুইট করেন, ‘‘রাজ্যপালের ভাষণ শুনে মনে হচ্ছিল, যেন উনি রাজ্য বিধানসভায় বাজেট অধিবেশন শুরুর আগে যে ঔপচারিক বক্তৃতা দেবেন, তারই মহড়া দিলেন।’’ পরস্থিতি এমন জায়গায় যায় যে, বিজেপি-রাজভবন সম্পর্ক মেরামত করতে যান রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হয় দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে।
ওই সাক্ষাতের পরেই প্রথম রাজভবন-নবান্ন সংঘাত হয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রাজ্যপাল জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে যথা সময়ে ‘কার্যকরী ও সক্রিয়’ হস্তক্ষেপ করা হবে। নির্বাচনে হিংসার কোনও স্থান নেই। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোট যাতে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তা-ও নিশ্চিত করা হবে। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে শাসকদলের হিংসার কথা যে বিজেপি সভাপতিই তাঁকে জানিয়েছেন, তা-ও নিজের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন রাজ্যপাল। সেই সঙ্গে রাজ্যে লোকায়ুক্ত নিয়োগ নিয়েও তিনি কড়া অবস্থানের কথা জানান। তার কাছাকাছি সময়েই সেই সময়েই কোচবিহারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের উপরে হামলার ঘটনায় কড়া বিবৃতি দেন আনন্দ। ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্টতই ‘খুশি’ শুভেন্দু বলেছিলেন, রাজ্যপাল ‘ট্র্যাকে’ আসছেন। অর্থাৎ, ‘পথে’ আসছেন।
দ্বিতীয় সংঘাতও সুকান্তের সঙ্গে বৈঠকের পরেই। রাজ্যপালের প্রধান সচিব পদে থাকার সময়ে আইএএস নন্দিনী চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে শাসকদল তৃণমূলের প্রতি ‘পক্ষপাত’ করার অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। শেষ পর্যন্ত নন্দিনীকে সরিয়ে দেন আনন্দ। তৃণমূল এর নিন্দা করলেও চুপ ছিল নবান্ন। কয়েক দিন পরে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে নিঃশব্দে নন্দিনীকে রাজভবন থেকে পর্যটন দফতরে পাঠিয়ে দেয় রাজ্য সরকার।
নন্দিনীর অপসারণের পরে রাজভবনের প্রধান সচিব বেছে নেওয়ার জন্য তিনটি নাম পাঠায় নবান্ন। তাঁরা হলেন অত্রি ভট্টাচার্য, বরুণকুমার রায় এবং অজিত বর্ধন। কিন্তু এঁদের কাউকেই বেছে নেননি রাজ্যপাল। রাজভবন সূত্রে জানা যায়, তৃতীয় একজন বোসের পছন্দের ছিলেন। তবে এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাবে তা নিয়ে রাজভবন বা নবান্ন কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। ওই পদ খালিই রয়ে গিয়েছে।
চতুর্থ সংঘাত সম্প্রতি রামনবমী ঘিরে হাওড়ায় অনভিপ্রেত অশান্তিকে কেন্দ্র করে। অশান্তি শুরুর পর দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ফোন পান রাজ্যপাল। আর তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ‘একান্ত’ আলোচনা করেন। সেই সঙ্গে তিনি একটি বিবৃতি জারি করেন। সেখানে নবান্নের থেকে রিপোর্ট চাওয়ার পাশাপাশিই রাজ্যপাল কার্যত ঘোষণা করেন, হাওড়ার প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি জানতে রাজভবনের তরফে ‘বিশেষ সেল’ খুলেছেন তিনি। এমন সেল খোলার ‘বৈধতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তৃণমূল। কিন্তু নবান্ন তখনও নীরবই ছিল।
কিন্তু পঞ্চম সংঘাতে নবান্ন আক্রমণাত্মক হয়েছে। রাজ্যপালের সাম্প্রতিক নির্দেশ নিয়ে শুরু হয়েছে সংঘাত। নবান্ন সূত্রের খভর, এই প্রশ্নে রাজ্য সরকার ‘কঠোর এবং আক্রমণাত্মক’ মনোভাবই নেবে। দরকার হলে আইনি লড়াইয়েও যাবে। নির্দেশটিতে বলা হয়েছে, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্তর্বর্তী উপাচার্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ্তাহিক কাজের রিপোর্ট রাজভবনে আচার্যের কাছে পাঠাতে হবে। রাজ্যপালের আগাম অনুমোদন নিতে হবে আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে। যে নির্দেশ সম্পর্কে ব্রাত্য সাফ জানান, উচ্চশিক্ষা দফতরকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এই চিঠি উপাচার্যদের পাঠানো হয়েছে। রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে এমন ভাবে চিঠি পাঠানো যায় কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। ব্রাত্য শুক্রবার বলেন, ‘‘ওই চিঠির বৈধতা আছে কি না, তা দেখতে হবে। আমি উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিবকে আইনি পরামর্শ নিতে বলেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy