ফাইল চিত্র।
করোনা ও সেই সূত্রে বিধ্বস্ত অর্থনীতির জেরে চড়া বেকারত্বের কবলে দেশ। তার মধ্যেও রাজ্যে তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফেরা তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার যে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরিতে বদ্ধপরিকর, সম্প্রতি বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের (বিজিবিএস) মঞ্চ থেকে সেই বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দাবি করেছেন, গত এক দশকের লগ্নি প্রবাহে বাংলায় কাজের সুযোগ বেড়েছে বহু গুণ। বেকারত্ব কমেছে প্রায় ৪০%। এই দফায় নিবিড় শিল্পায়ন সেই সাফল্যকেই নতুন শিখরে ঠেলে তুলবে। কিন্তু বিরোধী শিবিরের কটাক্ষ, শিল্পে লগ্নিরই দেখা নেই, তো কর্মসংস্থান হবে কোথা থেকে?
এ বারের বিজিবিএসেও কর্মসংস্থানের অসংখ্য প্রতিশ্রুতি এসেছে। কিন্তু বিরোধী শিবিরের কটাক্ষ, পুরোটাই অবাস্তব দাবি আর শুকনো প্রতিশ্রুতিতে চিঁড়ে ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা। শিক্ষক থেকে শুরু করে বহু ক্ষেত্রে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এবং মামলা-মোকদ্দমার তথ্যও তুলে ধরছে তারা।
প্রশাসনিক মহল জানাচ্ছে, গত এক বছর ধরে কর্মসংস্থানকেই নিশানা করে এগোচ্ছে রাজ্য সরকার। অর্থ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) প্রসার কাজের সুযোগ বাড়িয়েছে। সামাজিক এবং অন্যান্য প্রকল্পেও কর্মসংস্থানমুখী পদক্ষেপ করা হচ্ছে। আর মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, রাজ্যে কর্মদিবস নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ঠেকানো গিয়েছে বলেই শিল্পমহল লগ্নিতে আগ্রহী। ফলে কাজ-কারবার আরও বাড়বে। যদিও বিরোধীদের একাংশের প্রশ্ন, ক্ষমতায় আসার আগে এই তৃণমূল কংগ্রেসের ডাকা বন্ধ-ধর্মঘটেই যে অজস্র শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছে, তার হিসাব কোথায়? এখন কথায় কথায় সরকারি ছুটি ঘোষণার কর্মসংস্কৃতিতেও কি তা কমছে না? লগ্নিকারী কেন আসবেন?
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এখন বাড়তি জোর দেওয়া হচ্ছে শিল্পমুখী কারিগরি শিক্ষায়। সে জন্য উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শদাতা কমিটি তৈরি হয়েছে। শিল্পের চাহিদা বুঝতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা দফতর সেই মতো প্রশিক্ষণ দেবে। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ-সহ বিভিন্ন দফতরে চুক্তি-ভিত্তিক নিয়োগও হচ্ছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও খাদ্য দফতরে এই ভাবে নিযুক্ত হয়েছেন ১২,০০০ কর্মী। গত অর্থবর্ষে (২০২১-২২) মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্ম নিশ্চয়তা প্রকল্পে ১.১১ কোটি অদক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত করে দেশে প্রথম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কর্মদিবস তৈরিতে দ্বিতীয়। পর্যটনে কর্মসংস্থান বাড়াতে এসেছে গাইড প্রশিক্ষণের নীতি।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, বিজিবিএসের লগ্নি প্রস্তাবগুলি প্রায় ৪০ লক্ষ কর্মসংস্থানের সূত্র তৈরি করবে। রাজারহাটের সিলিকন ভ্যালিতে তথ্যপ্রযুক্তি ও ডেটা সেন্টার গড়ছে বিভিন্ন সংস্থা। সম্প্রতি রাজ্যে পা রেখেছে মাইন্ডট্রি-র মতো সংস্থাও।
সম্ভাবনার কথা মেনে নিলেও আইআইএম-কলকাতার অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক অনুপ সিন্হার প্রশ্ন, ‘‘কাজ সে ভাবে কোথায়? হয় নেই, নয়তো পারিশ্রমিক যথেষ্ট নয়। লগ্নি না এলে চাকরি-বাকরি বাড়বে কী ভাবে?’’ তাঁর দাবি, রাজ্যে মধ্য মেধার কাজের সুযোগ বাড়ছে না। কেউ অবসর নিলে, সেখানে পুনর্নিয়োগ কর্মসংস্থান বাড়ায় না। যদিও শিক্ষা ক্ষেত্রে বহু পদে পুনর্নিয়োগও হয়নি।
একাংশের অভিযোগ, কাজ যেটুকু বেড়েছে সেটা অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং অস্থায়ী। অনুপবাবুও বলছেন, ‘‘এখন চারপাশে বহু ছেলেমেয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য বাড়িতে পৌঁছে দেয় (ডেলিভারি)। হয়তো অসংগঠিত ক্ষেত্রেও কিছু কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু ওইটুকুই। সেগুলিতে শ্রমবিধি, সামাজিক সুরক্ষার মতো বিষয় মানা হয় কি না সন্দেহ।’’
শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে তোলপাড় রাজ্য। নতুন করে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন চলছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের এসএসসি (স্কুল সার্ভিস কমিশন) প্যানেলের মেয়াদ বাড়বে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৫২৬১টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পেশ হয়েছে। কর্মশিক্ষা এবং শরীরশিক্ষার জন্য প্রস্তাব অতিরিক্ত ১৬০০টি পদ তৈরির। এসএসসি জানিয়েছে, সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ শুরু হবে। যদিও শিক্ষা শিবিরের একাংশের মতে, এগুলি ঘোষণামাত্র। নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দিশাহীন শিক্ষা দফতর। প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য জানান, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো ১৬,৫০০ জন শিক্ষকের নিয়োগ সম্পূর্ণ।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, আলিপুরদুয়ারে গত এক বছরে পিএমইজিপি প্রকল্পে প্রায় ৫০টি ছোট কারখানা এবং একটি তেল মিল মিলিয়ে ৩০০ জনের মতো কাজ পেয়েছেন। ১০০ দিনের কাজ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার লক্ষের। কোচবিহারে তা কয়েক লক্ষ। এমএসএমই-তে মালদহের প্রায় ১৫টি কারখানায় কর্মসংস্থান ৩০০০। তবে বিরোধীদের অভিযোগ, ছোট শিল্পে কাজের সুযোগ কম। তাই জেলা থেকে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি অব্যাহত। জলপাইগুড়িতে অন্তত ৩২টি ছোট শিল্পে কিছু কাজের সুযোগ খুললেও, কারখানা বন্ধ হওয়ায় কাজ খুইয়েছেনও কিছু জন।
দার্জিলিং জেলার সমতলে গত অর্থবর্ষে মোট কর্মদিবস তৈরি হয়েছে ১৭,১৯,৩৯৩। উত্তর দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন দফতরে ৩০ জনের মতো চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ হয়েছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির স্থায়ী সরকারি কর্মী পদে ১৫ জন। কর্মসংস্থান হতাশাজনক দক্ষিণ দিনাজপুরে। বালুরঘাট পুরসভা চুক্তিভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন অনিয়মিত বলে অভিযোগ। বেকারদের কর্মতীর্থ প্রকল্পে বিনামূল্যে দোকান দেওয়া হলেও সেগুলি বন্ধ। চালকলের সংখ্যা কমায় বেকারত্ব বেড়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হাওড়াতেও ছবিটা মলিন। বরং ফের ভিন্ রাজ্যে যাওয়ার হিড়িক বেড়েছে। হুগলি ও উত্তর ২৪ পরগনায় কিছু প্রকল্পে কয়েক হাজার কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। পশ্চিম বর্ধমান জেলা শিল্পকেন্দ্রের হিসাবে, গত দু’টি অর্থবর্ষে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮১৭৬ জনের। গত এক বছরে বাঁকুড়ায় প্রায় ৪০৮, পূর্ব বর্ধমানে ৭৬,৪৫৯ জন, এমএসএমই ক্ষেত্রে পুরুলিয়ায় প্রায় ৩০০০ জন কাজ পেয়েছেন।
এখন রাজ্যের কাজের বাজারের ভরসা আপাতত আশ্বাসই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy