আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের পুঁটিরাম এখন শুধুই স্মৃতি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন
নগর কলকাতার খাদ্যনামায় সুর বসালে কেমন গান বেজে উঠবে? প্রশ্ন ছুড়ে দিলে খাদ্যরসিকেরা চুলোচুলি কাণ্ড ঘটাবেন নিশ্চিত। কিন্তু একটি বিষয়ে তাঁরা একমত হবেন যে, সেই খাদ্য-সিম্ফনির ‘ফিনালে’ অথবা দেশি কেতায় বললে খাদ্য-কীর্তনের ‘ভাবসম্মেলন’টি অবশ্যই মধুরেণ। সেই মধুতে খানিক লবণের সাহচর্যও যে থাকবে না, তা নয়। দুইয়ে মিলে যে স্বরলিপিটি তৈরি হবে, তার নাম ‘মিষ্টান্ন ভান্ডার’। কলকাতার সেই স্বরলিপিটি থেকে একটি স্বরস্থান বন্ধ হয়ে গেল। পুঁটিরাম। আর্মহার্স্ট স্ট্রিট আর মহাত্মা গান্ধী রোডের সংযোগস্থলের শতাব্দীপ্রাচীন মিষ্টির দোকানটি চিরকালের মতো ঝাঁপ বন্ধ করে ফেলল কিছু দিন আগে। ঠিক কেন বন্ধ হল এমন একটি বিপণি? নতুন প্রজন্মের রুচি কি আজ শিঙাড়া, রাধবল্লভী, আবার খাবো সন্দেশ কিংবা ছানার পোলাও থেকে দূরে সরে গিয়েছে? না কি অন্য কোনও কারণ?
আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন রেখেছিল বন্ধ হয়ে যাওয়া আর্মহার্স্ট স্ট্রিট পুঁটিরামের কর্তা পরেশ মোদকের কাছে। তিনি জানালেন, নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ নয়, মূলত বয়স আর শারীরিক কারণেই দোকান চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। পুঁটিরাম মোদকের বংশধরেরা মূলত তিনটি বিপণি চলাতেন। যার মধ্যে একটি আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মির্জাপুর স্ট্রিট তথা সূর্য সেন স্ট্রিটের দোকানটি এখনও স্বমহিমায় বর্তমান। কিন্তু, ৭০ ছুঁইছুঁই পরেশবাবুকে ব্যবসায় দাঁড়ি টানতে হল। পরবর্তী প্রজন্ম আর ব্যবসা চালিয়ে যেতে উৎসুক নয়। সেই সঙ্গে দোকান বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না পরেশবাবু। কারণ, গুডউইলের সঙ্গে আপস করাকে অনৈতিক বলেই মনে করেন তিনি। আর তা ছাড়া তাঁদের দোকানের নোনতা খাবারের জনপ্রিয়তা যে প্রজন্ম পরম্পরায় অটুট ছিল, তা অস্বীকার করা যাবে না। বিকেলের আগেই ফুরিয়ে যেত সদ্য ভাজা রাধবল্লভী, কচুরি। তার ভোক্তাদের একটি বড় অংশই ছিলেন বইপাড়ায় আগত তরুণ প্রজন্মের থেকে আগত।
পুঁটিরামের খ্যাতি ছিল নোনতা, মিষ্টি দু’রকম খাবারেই। দুপুর-বিকেল নাগাদ রাধাবল্লভী ভাজা হত পুঁটিরামে। সাধারণত গ্রীষ্মেই। শীতে তা বদলে যেত কড়াইশুঁটির কচুরিতে। কিন্তু এই দুই কিসিমের সঙ্গে যেটি তাল দিত, সেটি এক বিশেষ আলুর দম। তার রং সাদা, হলুদের স্পর্শ থাকত না তাতে। উপরে খানিক কাঁচালঙ্কা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও তার স্বাদ ছিল মোটের উপর মিষ্টি। সেই আলুর দমের ঝোলে রাধাবল্লভী বা কচুরির মাখামাখি যুগলবন্দি ক্রেতাদের হাতে তুলে দিতেন দোকানের কর্মী। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই সুখাদ্যের স্বাদ নিতে হত, কারণ পুঁটিরামের এই দোকানে বসে খাওয়ার কোনও বন্দোবস্ত ছিল না। এই সব কথা বলতে গিয়ে খানিক স্মৃতিকাতর মধ্য চল্লিশের সুকল্প চট্টোপাধ্যায়। পেশায় প্রকাশক আর নেশায় কবি সুকল্পের কলেজ স্ট্রিটে আনাগোনা ছাত্রজীবন থেকেই। বইপাড়ার উপান্তে পুঁটিরামের এই শাখাটির প্রতি তাঁর দুর্বলতা জন্মানোর অন্যতম কারণ ওই রাধাবল্লভী বা কচুরি ও আলুর দম। পরে যখন কাজের সুবাদের বইপাড়াতেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতে হল, তখনও সূর্য সেন স্ট্রিট ধরে পুবমুখো হাঁটা দিয়ে খেয়ে আসতেন রাধাবল্লভী, আলুরদম। বিপণিতে কোনও অনুষ্ঠান থাকলে পুঁটিরামেই বরাত দিতেন শিঙাড়া ও অন্য কোনও মিষ্টির। সুকল্প জানালেন, সেই শিঙড়ার পুরে কাজুবাদাম, কিশমিশের মতো ড্রাইফ্রুটও থাকত। আর একটা বিষয় ছিল এ দোকানের খাস্তা কচুরি। সুকল্পের মতে, সেটির সঙ্গে কলকাতার কোনও দোকানের খাস্তা কচুরিরই তুলনা চলে না। এক হাতে খাস্তা কচুরি আর অন্য হাতে সম-মাপের, সম-আকৃতির ক্ষীরের চপ নিয়ে প্রথমটিতে এক কামড় আর দ্বিতীয়টিতে একটি— এই ভাবে সারা হত বৈকালিক আহার।
● পুঁটিরামকে নিয়ে আর একটি গল্প বললেন সুকল্প। এক দিন তাঁর দফতরে কিছু অভ্যাগতের আসার কথা। বেশ কিছু গরম শিঙাড়া থলেবন্দি করে তিনি ঢুকেছেন মহেন্দ্র দত্তের ছাতার দোকানে। সেই বিপণির এক কর্মী শিঙাড়ার গন্ধ পেয়ে শুধোলেন— “পুঁটিরাম?” ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানানোয় বললেন, “আমাদের দোকানের মালিক তো ও দোকান ছাড়া অন্য কোনও শিঙাড়া খান না। আর পালা-পার্বণে পুঁটিরাম থেকেই আসে আমাদের খাবার।” সদ্য বন্ধ হওয়া পুঁটিরামের মালিক পরেশ মোদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনিও প্রসঙ্গ তুললেন সেই ছাতার দোকানের দুই কর্তা আশুবাবু আর তারিণীবাবুর। পুঁটিরাম ছাড়া নাকি তাঁদের চলতই না। আরও জানালেন, দই, ক্ষীরের চপ, রাধাবল্লভী আর আবার খাবো সন্দেশের খ্যাতি নাকি টেনে আনত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষকেও। অবশ্য সৌমিত্র তখন মির্জাপুর স্ট্রিটের বাসিন্দা। পরেশবাবুর স্মৃতিতে ভাস্বর আনন্দ পাবলিশার্সের প্রসঙ্গও। বাংলা নববর্ষে আনন্দের আপ্যায়নে অবধারিত পদ ছিল পুঁটিরামের শনপাপড়ি। এ ছাড়া কত খ্যাতজন তাঁদের দোকানে এসেছেন বা নিয়মিত আসতেন আজ আর মনে করে বলা দুরূহ, জানালেন পরেশবাবু।
শুধু যে নোনতা খাবার বা ভাজা মিষ্টি, তা নয়। পুঁটিরামের খ্যাতি ছিল দই আর ছানার পোলাওয়ের মতো মিষ্টিতেও। সন্দেশও কিছু কমতি ছিল না, জানালেন, ষাটে পৌঁছনো দেবাশিস বিশ্বাস। সোদপুরের বাসিন্দা দেবাশিস বেলেঘাটা সেলস ট্যাক্সের আধিকারিকের চাকরি থেকে এখন অবসরে। কিন্তু চাকরি চলাকালীন লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের সূত্রে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বইপাড়ায়। হেঁটেই মেরে দিতেন বেলেঘাটার বিক্রয় কর দফতর থেকে কলেজ স্ট্রিট। পথে পুঁটিরাম। অনেক দিনই বিকেলের জলখাবার সেরে নিয়ে ঢুকতেন প্রেসে অথবা কফি হাউসে। আর মঝেমধ্যে দুপুর-বিকেল নাগাদ ও পাড়ায় গেলে অবশই রাধাবল্লভী, আলুরদম ছেড়ে আসতেন না। ফিরতি পথে শিয়ালদিহ স্টেশনের দিকে যাওয়ার সময় প্রায়শই কিনে নিয়ে যেতেন ছানার পোলাও। দোকানটি উঠে যাওয়ায় বেশ বিষণ্ণই লাগল তাঁকে।
কলকাতার খাদ্য-সংকীর্তন থেকে খসে পড়ল একটা আখর। সেই আখরটির শূন্যতা ভরাট করার পথও রুদ্ধ। ২০২৪-এর জুন নাগাদ বন্ধ হয় পুঁটিরাম। সেই জায়গায় পৌঁছতেই দেখা গেল নীল রঙের উপরে সাদা হরফে লেখা সাইনবোর্ডটিও আর নেই। একটু কি বর্ণহীন হয়ে পড়ল রাজা রামমোহন রায় সরণি আর মহাত্মা গান্ধী রোডের চৌমাথা? শহরের স্বাদের বলয় থেকে বেশ কিছু পদ উধাও হল, কিন্তু সেই সঙ্গে শতাধিক বছর ধরে চোখে লেগে থাকা অভিজ্ঞানচিহ্নটিও যে লোপ পেল, তা টের পাওয়া গেল দোকানের স্থানটিতে পৌঁছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy