প্রতীকী ছবি।
অল্পবয়সি মেয়েরা একের পর এক আচমকা হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে। যেন স্রেফ উবে যাচ্ছে কর্পূরের মতো।
স্কুলে পড়াতে পড়াতে শিক্ষক বলছেন, ‘‘চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। বিয়ে, চাকরি, নতুন মোবাইল বা গয়নার লোভ দেখিয়ে কেউ কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে ভুলেও রাজি হবে না।’’ শুনতে শুনতে ক্লাসে উঠে দাঁড়ায় একটি মেয়ে। ‘‘স্যর, আমার দিদিও তো এ ভাবেই...’’ কথা শেষ করতে পারে না সে। জানা যায়, তার দিদি সপ্তাহ তিনেক ধরে নিখোঁজ। উঠে দাঁড়ায় আর এক জন। তার পাশের বাড়ির দিদিরও তো হদিস মিলছে না!
এ ভাবেই চলছে। এমন ভাবেই ক্রমশ কিশোরী-শূন্য হয়ে পড়ছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী ব্লকের রামচন্দ্রখালি গ্রাম। অভিযোগ, পুলিশের কাছে জানিয়েও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। বরং বহু ক্ষেত্রেই পাচারের সঙ্গে যুক্ত লোকজন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামেই।
প্রতি মাসে ছাত্রীদের নিয়ে বসছেন স্কুলের শিক্ষকেরা। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রচার চালাচ্ছে। কন্যাশ্রী ক্লাবের তরফেও কর্মসূচি থাকছে। তবু এখনও রামচন্দ্রখালি গ্রামে কৈশোরে পা রাখতে না রাখতেই মেয়েদের বিয়ের চেষ্টা শুরু হয়। দু’চার জন মেয়ে নিজের চেষ্টায় বিয়ে আটকায় বটে, কিন্তু সে সংখ্যা নেহাতই নগণ্য।
যেমন সাবিনা (নাম পরিবর্তিত) মারা গিয়েছে দু’বছর আগে। তাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রামচন্দ্রখালির অন্য মেয়েদের মতো সে-ও এক দিন নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল গ্রাম থেকে। দিন কয়েক পরে তার দেহ উদ্ধার হয়। সাবিনার বাবা এখন পাচারবিরোধী প্রচারের কাজ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘নিজের মেয়েটাকে তো বাঁচাতে পারলাম না। অন্য মেয়েগুলোকে যদি পারি।’’ আদালতে মামলা চলছে। বাবা বলেন, ‘‘একটা নৌকা ছিল। মামলার খরচ চালানোর জন্য সেটা বেচে দিয়েছি। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’
গ্রামেরই আর এক বাসিন্দা সইফুল মোল্লা (নাম পরিবর্তিত) জানান, তাঁর নিজের মেয়ে তো হারিয়েছে বটেই, পাশাপাশি তাঁর পাড়াতেই শেষ কয়েক সপ্তাহে চার জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মেয়ে আমার শালীর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। বিয়ের নাম করে ওকে ফুসলানোর চেষ্টা চলছিল। যে এটা করেছে, তাকে চিহ্নিত করেছিল আমার শালীর পরিবার। লাভ হয়নি। সে বহাল তবিয়তে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’ তাঁর অভিযোগ, থানায় ঘুরে ঘুরে জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকজন থানা ঘেরাও করেছেন। পুলিশের কাছ থেকে আশ্বাস মিলেছে শুধু। হারানো মেয়েরা বাড়ি ফেরেনি।
পাচার যে কত বড় সমস্যা তা বারুইপুর পুলিশ জেলার ওয়েবসাইট খুললেই বোঝা যাবে। পাচারবিরোধী প্রচারের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে সচেতনতামূলক নানা তথ্য। প্রশ্ন উঠেছে, তার পরেও পুলিশের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন? বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার রশিদ মুনির খান বলেন, ‘‘বাসন্তী থানা এলাকা থেকে পাচার হওয়া বেশ কিছু মেয়েকে আমরা দিল্লি, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব, রাজস্থান থেকে উদ্ধার করেছি। সেখানকার যৌনপল্লিতে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল তাদের। সুতরাং পুলিশ কিছু করছে না, সেই অভিযোগ ঠিক নয়।’’
কিন্তু একটা গোটা গ্রামের বড় সংখ্যক বাসিন্দা যে ঘরের মেয়েদের নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁরা যে বার বার বলছেন, পুলিশ সহযোগিতা করছে না, সেটা কি তা হলে মিথ্যা? পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘রামচন্দ্রখালি গ্রাম নিয়ে কী কী অভিযোগ জমা পড়েছে, আমি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখছি। কোনও তরফে যদি কোনও গা ছাড়া মনোভাব থাকে, তা হলে সেটা মেনে নেওয়া হবে না।’’
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজারও দাবি, ‘‘আমরা ব্লক স্তর থেকে পাচারবিরোধী কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছি। আরও নীচের স্তরেও করা হবে। শিশু সুরক্ষার জন্য কমিটিও রয়েছে। পাচারের ঘটনা অনেকটাই রোখা সম্ভব হচ্ছে।’’ তা হলে রামচন্দ্রখালির মেয়েরা সেই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে পাচার রোখার কাজে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কথায়, ‘‘আগে পাচারকারীদের চিহ্নিত করা সহজ হত। এখন তারা অল্পবয়সি, সুদর্শন ছেলেদের দালাল হিসেবে নিয়োগ করছে। তাতে বহু মেয়েকে সহজে প্রভাবিত করা যাচ্ছে। আর শুধু অন্য রাজ্য নয়, এই মেয়েরা পাচার হচ্ছে বিভিন্ন জেলাতেও। সেখানকার রিসর্টে তাদের যৌন ব্যবসায় নামানো হচ্ছে।’’
রামচন্দ্রখালি গ্রামের স্কুল শিক্ষক জাফর ইকবাল ও তাঁর সহকর্মীদের চেষ্টায় পাঁচ বছর আগে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল পাচার হয়ে যাওয়া ওই গ্রামেরই আবিদা লস্কর (নাম পরিবর্তিত)। তবে মেয়েটি তার মাস কয়েকের মধ্যেই রোগে ভুগে মারা যায়। হেপাটাইটিস বি ধরা পড়েছিল যৌনপল্লিতে পাচার হওয়া আবিদার। তাকে বাঁচাতে না পারার কষ্ট এখনও কুরে কুরে খায় জাফরকে। তিনি বলেন, ‘‘বার বার হেরে যাচ্ছি আমরা। নতুন নতুন ছক করছে পাচারকারীরা। স্কুলের সামনে ফুচকাওয়ালা, আচারওয়ালাদেরও চর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক জায়গায়। বাইরে থেকে আসা মোটরসাইকেল চড়া ছেলেরা তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে।’’ জাফর জানান, গোড়ায় পাচারকারীরা বেশ কিছু টাকা খরচও করছে। হয়তো দামি মোবাইল বা একটা গয়না উপহার দিল মেয়েটিকে। মেয়েটি ভাবল, ভাল না বাসলে এমন উপহার দেবে কেন? ওই ভাবনাই কাল হয় তার। ১০ হাজার টাকার মোবাইল পেয়ে দু’লাখে বিক্রি হয় মেয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy