সাহিত্য অনুষ্ঠানে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
সাহিত্যকে দেখার রাস্তা হাতড়াচ্ছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। সেই সূত্রেই গ্রামবাংলার একাংশে সমাজের নিচুতলার স্কুলে শিক্ষার ব্যর্থতার বেদনাই তাঁর স্বরে উঠে এল। শনিবার কলকাতা লিটারারি মিটের উদ্বোধনী আসরে গায়ত্রী বলছিলেন, ‘‘আমাদের শিক্ষকেরা যে ভাবে পড়াতেন, একেবারে নিচুতলায় তাঁদের মতো পড়ানো কঠিন, কারণ প্রাথমিক স্কুলগুলি আর স্কুল নেই। এটা এখন সবার জানা যে, প্রাথমিক স্কুলের চাকরিগুলি বিক্রি হয়ে গেছে! আমি তাঁদের চিনি যাঁরা এটা কেনেন। কী ভাবে কখন দরদাম পাল্টায়! এ ছাড়াও চাল চুরির জায়গা স্কুলগুলি। কাগজ পড়ে নয়, এটা একদম হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।’’
আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বীরভূমের গরিব আদিবাসী শিশুদেরও পড়ান গায়ত্রী। বিশ্ববরেণ্য সাহিত্য তত্ত্ববিদ, অশীতিপর বাঙালিনি একযোগে বেশ কয়েকটি ভুবনে বিচরণ করেন। তাঁর আক্ষেপ, একেবারে নিচুতলা থেকে সব থেকে বিত্তশালীদের ভুবনেও সাহিত্য পাঠ পৌঁছনোর কিছু খামতি থেকে গিয়েছে। গায়ত্রীর মতে, ‘‘পাঠ্য বিষয়কে নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্ষমতাশালীদের ছেলেমেয়েরাও ইদানীং তেমন শেখে না। আমরা বাস্তবের ভিত্তিতে শেখাই না। শেখানোর কিছু পদ্ধতি বা ছক মেনে চলি। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বৈচিত্র্য তাই পড়া হয় না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প, কমপ্লিট বিকল্প (সর্বাঙ্গীন) শিক্ষা দরকার।’’ ইতিহাসবিদ লক্ষ্মী সুব্রহ্ম্যণমের সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা এ দিন ভাগ করে নেন গায়ত্রী। বৈঠকী চালে শোনান, আমেরিকার নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আফ্রিকা, চিন বা ভারতের প্রত্যন্ত গ্রাম দেখার কথা।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে ছ’দিনের সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধনে বলতে এসে কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালির বইপ্রীতির কথায় উদ্বেল হয়েছেন গায়ত্রী। সেই সঙ্গে মনে করিয়েছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি কথাটা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সাহিত্যকে দু’ভাবে দেখার কথা বলেছেন। একটি দিক হল, অপরের ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়া, কোনও কবিতা ভালবেসে ভূতে-পাওয়ার মতো অনুভব। আর একটি হল সাহিত্যের উপযোগিতার দিক। গায়ত্রীর কথায়, ‘‘সাহিত্য মানে আত্মার শুশ্রূষাও। ডিজিটালের শুভ কাজে প্রয়োগ, পর্নগ্রাফি বা সাইবার জালিয়াতির থেকে যা আলাদা।’’
বীরভূম বা আফ্রিকার প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁর কয়েক দশকের অভিজ্ঞতার থেকে শিক্ষা নিয়ে এই আশির কোঠায় নতুন একটি ইনিংস শুরুর কথাও বলেছেন গায়ত্রী। বীরভূমে নতুন একটি স্কুলে হাত দিচ্ছেন তিনি। কিশোরী ‘গায়ত্রী চক্রবর্তী’কে উৎসর্গ করা বিনয় মজুমদারের কবিতার ভাব ধার করেই আজকের ডানপিটে প্রৌঢ়া সহাস্যে বলেন, ‘‘বিনয় ঝিনুকের মতো খুলে যেতে বলেছিলেন। ব্যর্থ হও, তবু ভিতরে বালি প্রবিষ্ট হতে দাও, মুক্তো হয়ে ওঠো। বোধহয়, এই মুক্তোর খোঁজে হতে খুলে যাওয়াই আমার জীবনের শেষতম পরীক্ষা! আমার স্কুলের পড়ুয়া, অভিভাবকদের নিয়ে ঝিনুকের মতো খুলতে চাওয়া বা ব্যর্থ হওয়াই হয়তো আমার ভবিতব্য।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy