কান্নায় ভেঙে পড়েছে রঞ্জিতবাবুর দুই মেয়ে রশ্মি (বাঁ দিকে) ও ঋতুপর্ণা। ছবি: নারায়ণ দে।
কোচবিহার থানার এসআই রঞ্জিত পালের (৫৩) মৃত্যু নিয়ে পুলিশ ‘মিথ্যা কথা’ বলেছে বলে দাবি করলেন রঞ্জিতবাবুর পরিবারের লোকজন। মঙ্গলবার, কালীপুজোর রাতে কোচবিহার শহর লাগোয়া ৪ নম্বর বাজার এলাকায় জুয়ার আসর বসেছে খবর পেয়ে চার জন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান রঞ্জিতবাবু। কোচবিহারের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব তার পরে দাবি করেন, জুয়াড়িরা পুলিশ দেখে পাথর ছুড়তে শুরু করে, তখনই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান রঞ্জিতবাবু। এসপি-র দাবি, ‘‘রঞ্জিতবাবুর গায়ে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না।’’ কিন্তু রঞ্জিতবাবুর বড় মেয়ে ঋতুপর্ণা দাসের দাবি, ‘‘পুলিশ কর্তারা মিথ্যা কথা বলছেন। বাবাকে জুয়াড়িরা বেধড়ক মারধর করায় ঘটনাস্থলেই ৫ মিনিটের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।’’ একই দাবি করেছেন রঞ্জিতবাবুর শ্বশুরমশায় পীযূষকান্তি নাথও। তিনিও বলেন, ‘‘জামাইয়ের শরীরে মারের দাগ রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। পুলিশকর্তারা ঘটনাটি ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”
পুলিশ সুপারও এ দিন জানান, প্রাথমিক তদন্তের উপরে ভিত্তি করেই ঘটনার পরপর বলা হয়েছিল যে রঞ্জিতবাবু হদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। তবে বুধবার খুনের মামলা রুজু করেই তদন্ত শুরু হয়েছে। ২১ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বুধবার কোচবিহার জেলা হাসপাতালে রঞ্জিতবাবুর দেহের ময়নাতদন্ত হয়। মৃতদেহের ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার রিপোর্ট এলে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, রঞ্জিতবাবুর যকৃত ও হৃদ্যন্ত্রের আকার কিছুটা বড় ছিল। বুকে এবং হাতে সামান্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ফলে কী করে তাঁর মৃত্যু হল, তা নিয়ে নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্তে এখনও পৌঁছতে পারেননি চিকিৎসকেরা।
এ দিন সকালে হাসপাতালে রঞ্জিতবাবুর স্ত্রী রত্নাদেবী, দিদি সাবিত্রী পাল, আত্মীয় সজল নাগ, হেমেন্দ্র পাল, অজন্তা নাগ সহ অনেকেই দাবি করেন, রঞ্জিতবাবুর কোনও গুরুতর অসুখ ছিল না। মঙ্গলবার রাত পৌনে ৭টা নাগাদ স্ত্রীকে ফোন করে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেন তিনি। রত্নাদেবী বলেন, “পুরোপুরিই সুস্থ ছিলেন। ভাইফোঁটায় ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসবেন বলেও জানান। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই ফোন পাই যে, তিনি আর নেই।’’ তাঁরও দাবি, ‘‘মারধর করা হয়েছে বলেই আমার স্বামী মারা গিয়েছেন।” রঞ্জিতবাবুর ভগ্নীপতি হেমেন্দ্রবাবু বলেন, “ময়নাতদন্তের আগেই কী ভাবে হৃদ্রোগে মৃত্যুর কথা বলা হল, তা আমরা পুলিশ আধিকারিকদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। কেউ কোনও উত্তর দিতে পারেননি। প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’’ তিনি জানান, প্রয়োজনে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবেন। নিচুতলার পুলিশকর্মীদেরও অনেকের অভিযোগ, জুয়াড়িদের হামলার ফলেই মৃত্যু হয় রঞ্জিতবাবুর। তাঁদের কয়েকজন বলেন, “এমন যদি অবস্থা হয়, কোন সাহসে আমরা চাকরি করব।”
রঞ্জিতবাবুর সঙ্গে যে পুলিশকর্মীরা ওই রাতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, তাঁরা অবশ্য মুখ খুলতে চাইছেন না। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কালীপুজোর রাতে রীতিমতো মণ্ডপ খাটিয়ে জুয়ার আসর বসানো হয়েছিল ওই এলাকায়। সেখানে ছিলেন শতাধিক লোক। সে ক্ষেত্রে কেন মাত্র চার জন কনস্টেবল নিয়ে রঞ্জিতবাবু ওই আসর ভাঙতে গিয়েছিলেন, সে প্রশ্নও উঠেছে। থানার আইসি-র বক্তব্য, রঞ্জিতবাবু ‘মোবাইল ডিউটি’তে ছিলেন, তাই জুয়ার আসর বসেছে খবর পেয়ে তিনি জিপ নিয়ে সেখানে চলে যান। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের অবশ্য দাবি, কর্তাদের উচিত ছিল, এ ক্ষেত্রে রঞ্জিতবাবুকে বড় বাহিনী দিয়েই পাঠানো।
রঞ্জিতবাবুর খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ওই রাতেই স্থানীয় ধাইয়ের হাট গ্রাম থেকে ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে। তা নিয়েও বির্তক শুরু হয়েছে। ওই এলাকার পঞ্চায়েত তৃণমূলের। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গভীর রাতে পুলিশের একটি বড় দল গিয়ে নানা জনের বাড়ির দরজা, জানালা ভেঙে দেয়। ঘরের ভিতরে ঢুকে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। দশম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন, “বাবা ভ্যান চালায়। রাতে বাড়িতে ঘুমোচ্ছিল। আচমকা পুলিশ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে বাবাকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায়। আমি ও মা বাধা দিতে গেলে আমাদের মারধর করে।” কোচবিহারের জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, ‘‘প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার কোনও চেষ্টা হচ্ছে না। কিন্তু ওই ঘটনায় যাঁদের ধরা হয়েছে, তাঁরা প্রকৃত অপরাধী নন।’’
পুলিশ সুপার অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই ওই ২১ জনকে গ্রেফতার করা
হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে খুন সহ একাধিক জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা করা হয়েছে। আদালত সূত্রের খবর, ধৃতদের ৫ জনকে দশ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। বাকিদের জেল হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy