আড়িয়াদহে জয়ন্তর নতুন অট্টালিকা। ছবি: শান্তনু ঘোষ।
মাত্র পাঁচ-ছ’বছরের মধ্যে দুধবিক্রেতা জয়ন্ত সিংহ থেকে ‘জায়ান্ট’ সিংহ।
এলাকায় অভিযোগ, শাসক দলের ‘ছত্রচ্ছায়ায়’ এসে কামারহাটির ‘ডন’ হয়ে উঠেছিল জয়ন্ত। নেপথ্যে অপরাধের দীর্ঘ অভিযোগ। তাতেই সংযোজন, পরিত্যক্ত জমি দখল করে মাত্র এক বছরের মধ্যে ‘প্রাসাদ’ তৈরি!
আড়িয়াদহ মৌসুমী মোড় থেকে কিছুটা এগোলেই প্রতাপ রুদ্র লেন। সেই গলির ভিতরেই মাত্র এক বছরের মধ্যে অট্টালিকা বানাল কী করে জয়ন্ত? প্রশ্ন ছিল সকলেরই। কিন্তু সাহস করে সেই প্রশ্ন কে করবেন, প্রাণের ভয় নেই? তাই চুপ করেই থাকতেন সকলে। স্থানীয় সূত্রের দাবি, বিশাল পুকুর ঘেঁষা জমিটি দীর্ঘ সময় ধরে পরিত্যক্ত। এলাকার বাচ্চারা মাঝেমধ্যে খেলা করত সেখানে। অভিযোগ, সেই জমি রাতারাতি নিজের কব্জায় করে নেয় আড়িয়াদহের ‘ত্রাস’ জয়ন্ত।
বুধবার সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, অট্টালিকায় প্রবেশের বিশাল মূল গেট তালাবন্ধ। যদিও ভিতরে দুই-এক জনের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মেরে দেখা গেল, ভিতরে দামি গাড়ি। আর বাড়ি টির এক ধারে পুকুরের একটা অংশ বস্তা ভর্তি বালি-পাথরের টুকরো ফেলে বোজানো হয়েছে। ওই গলি থেকে বেরিয়ে প্রধান রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোলেই বাঁ হাতের গলিতে জয়ন্তের পুরনো বাড়ি। সংলগ্ন বিশাল খাটাল। জনবসতির মধ্যে খাটাল চলছে কী ভাবে? আর, পরিত্যক্ত জমি বা কী ভাবে দখল করল বছর পঁয়ত্রিশের ‘জায়ান্ট’? বেলঘরিয়া, দক্ষিণেশ্বর থানা মিলিয়ে যার বিরুদ্ধে তোলাবাজি, হুমকি, মারধর, খুনের চেষ্টার অন্তত ৬-৭টি পুরনো মামলা রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, “রাজনৈতিক মদতে জয়ন্ত এতটাই ভয়ডরহীন যে, নিজেই বলে বেড়াত ও-ই আইন-আদালত। ওর উপরে কেউ নেই।” কিন্তু এমন কোন প্রভাবশালী নেতার ছত্রচ্ছায়ায় ছিল আড়িয়াদহের ওই দুষ্কৃতী? প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নন বাসিন্দারা। সাংবাদিক শুনে ঝটপট বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করে দিলেন প্রতাপ রুদ্র লেনের অধিকাংশ বাসিন্দাই। বহু জোরাজুরির পরে এক বাসিন্দার মন্তব্য, ‘‘এখন আমরা বলব, আর জেল থেকে এসে জয়ন্ত শোধ তুলবে। কী দরকার এ সবের মধ্যে থাকার! দেখুন, ক’দিন পুলিশ ওকে ধরে রাখতে পারে?”
অভিযোগ, এক প্রোমোটারের হাত ধরে শাসক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার ‘ঘরের লোক’ হয়ে উঠেছিল জয়ন্ত। এতটাই তার দাদাগিরি ছিল যে, সামান্য মতের পার্থক্য হলে নিজের দলের ছেলেদেরও মাফ করত না ওই দুষ্কৃতী। ২০২৩ সালের ২৯ জুন, আড়িয়াদহের বাসিন্দা, পেশায় প্রোমোটার অরিত্র ঘোষ ওরফে বুম্বাকে বাড়ির সামনেই পায়ে গুলি করে, বেধড়ক পিটিয়েছিল জয়ন্ত ও তার দলবল। স্থানীয় সূত্রের খবর, বুম্বা এক সময় জয়ন্তের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু জয়ন্ত চেয়েছিল, বুম্বাকে প্রোমোটিং ব্যবসা করতে হলে ‘জায়ান্ট-সিন্ডিকেট’-এ আসতে হবে। রাজি হননি ওই যুবক। তাঁকে গুলি করার পরে উত্তরবঙ্গে গা ঢাকা দিয়েছিল জয়ন্ত। ঘটনার ন’দিন পরে কালিম্পং থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। দেড় মাস জেল খাটার পরে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের স্বমূর্তি ধারণ করে জয়ন্ত।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রথমে তালতলা এলাকার প্রভাবশালী এক প্রোমোটারকে ‘স্থানীয় অভিভাবক’ বানিয়ে নিজের সাম্রাজ্য শুরু করে জয়ন্ত। প্রথমে বিভিন্ন প্রকল্পে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ, তার পরে শাসক দলের ‘মদতে’ বাহুবলী হয়ে সেই দ্রব্য ও কর্মী সরবরাহের সিন্ডিকেট তৈরি করে বলেও অভিযোগ। কিন্তু তাতে কত টাকা রোজগার হতে পারে, যে এত বড় বাড়ি মাত্র এক বছরে তৈরি করতে পারল ‘জায়ান্ট’?
প্রকাশ্যে আসতে না চাইলেও গোপনে অল্পবিস্তর মুখ খুলছেন স্থানীয় প্রোমোটারদের একাংশ। অভিযোগ, আড়িয়াদহের প্রতিটি প্রোমোটিংয়ে জমির কাঠা পিছু দু’লক্ষ টাকা ‘নজরানা’ দিতে হত জয়ন্তকে। কারও কারও ক্ষেত্রে আবার জয়ন্তের ‘আদালত’-এর নিদানে বছরে ২০-২৫ লক্ষ টাকা করে ‘নজরানা’ বেঁধে দেওয়া ছিল। এ সবের পাশাপাশি কয়েকশো সাট্টা-জুয়ার ঠেক চালানো, ভয় দেখিয়ে তোলা আদায়ের মতো একাধিক দুষ্কর্মে জয়ন্ত যুক্ত ছিল বলেও অভিযোগ। সাম্রাজ্য বাড়াতে বিহার থেকে ছেলে নিয়ে এসে তাদেরও তালিম দিয়ে তৈরি করছিল।
কামারহাটিতে শাসক দলেরই একাংশের অভিযোগ, রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে বিধায়ক মদন মিত্রের পাশেই দেখা যেত ‘জায়ান্ট’-কে। আবার যে তালতলা ক্লাব জয়ন্তের অপরাধের কার্যালয় হয়ে উঠেছিল, সেখানেও সভাপতি ছিলেন মদন। মদন-জয়ন্ত ঘনিষ্ঠতার বহু ছবি ইতিমধ্যে প্রকাশ্যেও এসেছে। যদিও মদনের দাবি, “আমি কামারহাটির সব কিছুরই সভাপতি। তা বলে জয়ন্তের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না।” তাঁর আরও দাবি, “ওরা কেউ শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় ছিল না। ওরা সব প্রোমোটিং করে। তা নিয়েই নিজেদের মধ্যে ঝামেলা। সাংসদ সৌগত রায়ের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। পুলিশকে কড়া হাতে দমন করতে বলেছি।”
আর পুরপ্রধান গোপাল সাহা বলেন, “জয়ন্তের বাড়ি যে জমিতে তৈরি হয়েছে, তার বৈধতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি, পুকুরের একটা অংশ বোজানোর অভিযোগও দেখা হচ্ছে। বেআইনি প্রমাণিত হলে পুরসভা ব্যবস্থা নেবে।” জনবসতি এলাকায় খাটালের বিষয়টিও ‘খতিয়ে দেখা’র কথা বলছেন পুরপ্রধান।
কিন্তু বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ‘আড়িয়াদহের প্রশাসন কি এত দিন কুম্ভকর্ণ হয়ে ছিল?’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy